Thursday 10 June 2010

সত্যের লড়াইয়ে আমার দেশ জয়ী : হাইকোর্টের রায়ে প্রকাশনা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত তিন মাস স্থগিত



অগণিত পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীর রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে দেশপ্রেমিক জনতার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর দৈনিক আমার দেশ আবার প্রকাশিত হলো। দীর্ঘ ৯ দিনের ঘোর অমানিশা কাটিয়ে আলোর প্রস্ফুটন ঘটলো উচ্চ আদালতের এক ঐতিহাসিক আদেশে। দৈনিক আমার দেশ-এর প্রকাশনা (ডিক্লারেশন) বাতিলে সরকারি সিদ্ধান্ত তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি প্রকাশক হিসেবে পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের করা আবেদন খারিজের আদেশও স্থগিত করেছেন আদালত। এছাড়া প্রকাশনা বাতিলের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে সরকারকে তার কারণ জানাতে বলা হয়েছে। মহামান্য হাইকোর্টের এ আদেশের মধ্য দিয়ে সত্যের জয় হলো। এখন দেশবাসী অধীর অপেক্ষায় রয়েছে আমার দেশ-এর সাহসী সম্পাদক, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পক্ষের অকুতোভয় সৈনিক মাহমুদুর রহমানের মুক্তির। লাখো-কোটি প্রতিবাদী জনতা দেশে-বিদেশে সংগ্রাম করছে মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবিতে।
আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বাতিলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের বেঞ্চ এ আদেশ দেন। পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আনোয়ার-উন-নবী গত সোমবার হাইকোর্টের এ বেঞ্চে আবেদনটি দায়ের করেন। বুধবার শুনানি শেষে আদেশের এ তারিখ ধার্য হয়েছিল। আদেশের আগে বৃহস্পতিবারও শুনানি হয়। রিট আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। সরকার পক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান।
আদেশের পর আবদুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, এ আদেশের ফলে আমার দেশ প্রকাশে আর বাধা নেই। ইচ্ছা করলে এখনই পত্রিকাটি প্রকাশ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, এ রায় একটি ঐতিহাসিক রায়। হাইকোর্টের এ রায়ের ফলে আইনের শাসনের বিজয় হয়েছে। হাইকোর্ট সংবাদ মাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সমুন্নত রেখেছে। এ আদেশ আইনের শাসন ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। রাষ্ট্রযন্ত্রের অবৈধ হস্তক্ষেপ ও কর্মকাণ্ডের যথাযথ জবাব দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এদিকে আমার দেশ-এর প্রকাশনা বতিল সংক্রান্ত সরকারি কালো আদেশ হাইকোর্টে স্থগিত হওয়ার খবর দ্রুত ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ার পর পত্রিকার অগণিত পাঠক, শুভাকাঙ্ক্ষী ও শুভানুধ্যায়ীরা ফোনে জানতে চান, আগামীকাল পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে কিনা? পত্রিকা যথারীতি প্রকাশিত হচ্ছে জেনে তারা কিছুটা স্বস্তি প্রকাশ করেন। পাঠকরা উদ্বেগাকুল কণ্ঠে মাহমুদুর রহমানের অবস্থা জানতে চান। রিমান্ডের নামে তার উওর শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের খবর জেনে অনেক পাঠক উত্কণ্ঠা প্রকাশ করেন। এদিকে হাইকোর্টের আদেশের পরই দৈনিক আমার দেশ কার্যালয় আগের মতোই কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে। সাংবাদিক ও কর্মীরা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দুপুরেই আমার দেশও-এর অনলাইন সংস্করণ প্রকাশ করা হয়।
এর আগে বুধবার শুনানিতে আবদুর রাজ্জাক বলেন, সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাকস্বাধীনতা সম্পর্কিত মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এ অনুচ্ছেদে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। আমার দেশের প্রকাশনা বাতিল করে সংবিধানের এ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করেছে সরকার।
সরকার পক্ষে এম কে রহমান বলেন, আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এবং কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েই পত্রিকাটির প্রকাশনা বাতিল করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রকাশক আলহাজ হাসমত আলী অনেক আগেই পদত্যাগ করেছেন। পত্রিকাটির ডিক্লারেশন তার নামে। পদত্যাগ করার পরও বেআইনিভাবে তার নামে পত্রিকাটি প্রকাশ করা হতো। এসব কারণে যথাযথভাবেই প্রকাশনা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
হাসমত আলীকে প্রকাশক করে ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। এরপর ২০০৮ সালে সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান আমার দেশ পত্রিকাটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেন। সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা ১ জুন পত্রিকার প্রকাশক হাসমত আলীকে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করায় ও ডিসি বরাবর একটি দরখাস্ত দেয়। রাতে কোনো ধরনের কাগজপত্র প্রদর্শন ছাড়াই ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়েছে বলে পত্রিকার প্রেসে পত্রিকার কিছু কপি ছাপা হওয়ার পরই এর ছাপা ও বিতরণ পুলিশ দিয়ে জোর করে বন্ধ করে দেয়া হয়। রাত পৌনে ১১টার দিকে কয়েকশ’ পুলিশ আমার দেশ অফিস ঘেরাও করে। কিন্তু কোনো বৈধ ওয়ারেন্ট ছাড়া পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করতে চাইলে সাংবাদিক-কর্মচারীরা আপত্তি জানায়। একপর্যায়ে রাত ৪টার দিকে পুলিশ জোর করে আমার দেশ অফিসে ঢুকে সাংবাদিকদের বেধড়ক লাঠিচার্জ করে সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে তার রুম থেকে ধরে নিয়ে যায়। গ্রেফতারের আগে প্রকাশক হাসমত আলীকে দিয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় দায়ের করা মামলার কথা বলা হলেও ২ জুন ভোরে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে অফিসে তাকে গ্রেফতার করতে বাধা দেয়ায় আরেকটি মামলা দেয়া হয়। প্রথম মামলায় মাহমুদুর রহমানকে আদালত জামিন দিলেও দ্বিতীয় মামলায় তাকে জেলে পাঠানো হয়। ৩ জুন মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে ২ জুন কোর্টে সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করা হয়। একই দিনে হিযবুত তাহরীরের অপর একটি মামলায় মাহমুদুর রহমানকেও আসামি করা হয়। ৪ জুন মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালে উত্তরায় সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেয়া হয়। একই দিনে মাহমুদুর রহমানকে পুলিশের কাজে অফিসে ও কোর্টে বাধা দেয়ার দুটি মামলায় ৪ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। পরদিন হিযবুত তাহরীরের মামলা ও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় তাকে আরও ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে নিম্নআদালত। ৮ জুন রাতে মাহমুদুর রহমানকে একদিনের রিমান্ডে নেয় কোতোয়ালি থানা পুলিশ। বর্তমানে তাকে দ্বিতীয় দফায় তিন দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। প্রথম দিনের রিমান্ডে নিয়েই তার ওপর নির্যাতন করা হয়েছে বলে মাহমুদুর রহমানের ২ জন আইনজীবী বুধবার তার সঙ্গে সাক্ষাত্ শেষে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছেন। এছাড়া জেলখানায়ও মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হয়েছে বলে মাহমুদুর রহমান নিজেই আদালতে অভিযোগ করেছেন। এছাড়া তিনি দুদিন আদালতে কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, সরকারের দুর্নীতি-অনিয়ম তুলে ধরা ও ভারতের আগ্রাসী তত্পরতার বিরুদ্ধে কথা বলার কারণেই তাকে গ্রেফতার ও পত্রিকা বন্ধ এবং তার ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। আমার দেশ পত্রিকার বৈধ প্রকাশক না থাকার অভিযোগে আমার দেশের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়।
আমার দেশ বন্ধ ও সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানান সর্বস্তরের মানুষ, মানবাধিকার কর্মী, সম্পাদক, বিশিষ্ট ব্যক্তি ও পেশাজীবী নেতারা। সব জাতীয় দৈনিকের ২৮ জন সম্পাদক এক যুক্ত বিবৃতিতে আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত রাখার ও সম্পাদককে মুক্তি দেয়ার দাবি জানান। আমার দেশ-এর সাংবাদিক-কর্মচারীসহ সর্বস্তরের সাংবাদিকরা জাতীয় প্রেসক্লাবে গত ৯ দিন ধরে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে আসছেন। পাশাপাশি আমার দেশ-এর ডিক্লারেশন বাতিলের সরকারি আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। তিন দিন শুনানি শেষে গতকাল আদালত আমার দেশ-এর প্রকাশনা অব্যাহত রাখার পক্ষে রায় দেন। এর ফলে সত্যের লড়াইয়ে আমার দেশ জয়ী হয়।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/06/10/34720

No comments:

Post a Comment