Wednesday 23 November 2011

অধিকার-এর সম্মেলনে মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান : এখন গুম করে বিচার বহির্ভূত হত্যা চলছে : অবশ্যই পোশাক পরে গ্রেফতার করতে হবে


বিশেষ প্রতিনিধি

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যার ক্ষেত্রে এখন কৌশল বদলানো হয়েছে। আগে ক্রসফায়ার বলা হতো, এখন নাগরিকদের তুলে নিয়ে গুম করা হচ্ছে। যাকে গুম করা হয়, তার হদিস পাওয়া যায় না। এমনকি পরিবার লাশের খোঁজও পায় না।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর উদ্যোগে মানবাধিকার কর্মীদের দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
অধিকার-এর সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সফররত সিনিয়র গবেষক আব্বাস ফয়েজ, আয়ারল্যান্ডভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ফ্রন্টলাইন ডিফেন্ডারের সফররত এশিয়াবিষয়ক কো-অর্ডিনেটর পকপং লাওয়াসিরি। উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট কবি ও বুদ্ধিজীবী অধিকার-এর উপদেষ্টা ফরহাদ মজহার।
ড. মিজানুর রহমান বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে অনেক লোক এসে নালিশ করেন—কারও স্বামী, কারও ভাই, কারও বাবা, কারও ছেলেকে সাদা পোশাকধারী লোকেরা ধরে নিয়ে যাওয়ার পর গুম করা হয়েছে, কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তখন মানবাধিকার কমিশন র্যাব-পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও শুধু বলা হয়, দেখছি স্যার। এর বেশি কিছু করারও থাকে না। তিনি পুলিশের ইউনিফরম ছাড়া গ্রেফতার বা আটক অভিযান বন্ধের জন্য সরকারের কাছে মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে দাবি জানান। তিনি বলেন, গ্রেফতার অভিযান কখনও সাদা পোশাকে হওয়া উচিত নয়। ইউনিফরম লাগিয়ে পুলিশের পোশাকে আটক বা গ্রেফতার অভিযান চালাতে হবে।
ড. মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের ক্রিমিনাল জাস্টিসের ব্যর্থতার কারণেই সাধারণত প্রথম দিকে ক্রসফায়ারকে মানুষ সমর্থন দিত এবং কারও ক্রসফায়ার হলে অনেকেই খুশি হতো। অপরাধীরা জামিনে বের হয়ে এসে অথবা বিচারে খালাস পেয়ে দ্বিগুণ উদ্যোগে অপরাধ করত। প্রথম দিকে ক্রসফায়ারকে অনেকেই ভালো বলে মন্তব্য করেছে। কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কখনও ভালো হতে পারে না। এটা সবারই মনে রাখতে হবে, অন্যের ঘরে আগুন লাগলে চুপ করে বসে থাকা উচিত নয়, সে আগুন নিজের ঘরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। ক্রসফায়ারও এখন সেই রূপ ধারণ করেছে। তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল ক্রসফায়ারের বিষয়ে জিরো টলারেন্স দেখানো হবে। নির্বাচনের পরও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ওয়াদা করেছিলেন, ক্রসফায়ারে জিরো টলারেন্স দেখানো হবে; কিন্তু সেই ওয়াদা সরকার রক্ষা করেনি। তিনি বলেন, একসময় অপরাধীদের ধরে এনে ডিটেনশন দেয়া হতো। এখন আর ডিটেনশন দেয়া হয় না, একেবারে পরপারে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, শুধু সরকারি পর্যায়ে নয়—বেসরকারি পর্যায়ে এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়েও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কোনো না কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপের উদ্যোগে সাধারণ মানুষের ভূমি দখল করে বা বিক্রি করতে বাধ্য করে আবাসিক প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে। এটাও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এই সংঘবদ্ধ চক্রটি হচ্ছে কালোটাকার মালিক। তারা টাকার বিনিময়ে সমাজের প্রভাবশালীদের কিনে নেয়। রাষ্ট্র যদি প্রশ্রয় না দিত, তারা এত সুচারুভাবে মানুষের জমি দখল বা বিক্রিতে বাধ্য করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ পেত না।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আব্বাস ফয়েজ বলেন, বাংলাদেশে সরকারি বিভিন্ন এজেন্সি ও পুলিশ মানুষের অধিকার রক্ষায় কাজ করে না। সরকার নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। পুলিশ ও র্যাবের মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রসঙ্গে তিনি লিমনের ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, প্রথম দিকে বলা হলো ক্রসফায়ারে লিমনের পায়ে গুলি আঘাত করেছে। পরে আবার বলা হলো লিমন একজন চিহ্নিত অপরাধী। তার বিরুদ্ধে একপর্যায়ে অস্ত্র মামলা দেয়া হলো। সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্য হিসেবে আরেকটি মামলা দেয়া হয় লিমনের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে তদন্তের জন্য সরকার একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। এই কমিটির রিপোর্ট আজও কেউ দেখতে পায়নি। তিনি বলেন, লিমনের বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আমাদের দেখানো হোক। সরকারের ভাষ্য সঠিক হয়ে থাকলে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট গোপন করা হলো কেন?
উদ্বোধনী বক্তব্যে ফরহাদ মজহার বলেন, আমাদের আগে ব্যক্তির মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তির মানবাধিকার নিশ্চিত হলেই সমাজে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করা যায়।

মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় সরকার চরম ব্যর্থ : অ্যামনেস্টি


স্টাফ রিপোর্টার

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কর্মসূচির দক্ষিণ এশিয়া প্রধান আব্বাস ফয়েজ বলেছেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। পরিস্থিতি এত ভয়াবহ যে, এখানে আজ মানবাধিকার কর্মীদেরও মানবাধিকার রক্ষা হচ্ছে না।
সাতক্ষীরায় সন্ত্রাসীদের হাতে শম্পা গোস্বামী নামের এক মানবাধিকার কর্মী লাঞ্ছনার ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশে এসে গতকাল সাংবাদিকদের কাছে তিনি এমনই মন্তব্য করেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবে অধিকার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি শম্পা লাঞ্ছনার ঘটনায় দায়ের করা মামলা তদন্তে পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, একজন মানবাধিকার কর্মী সন্ত্রাসীদের হাতে লাঞ্ছিত হলেও স্থানীয় প্রশাসন প্রথমে মামলাটি নিতে রাজি হয়নি। পরে মামলাটি রেকর্ড করলেও এ মামলার আসামিরা শম্পা গোস্বামীকে হুমকি দিচ্ছে। এমনকি তিনি যে স্কুলে চাকরি করেন সেখানেও তাকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। তাকে চাকরিচ্যুত করার চেষ্টা হচ্ছে। চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তিনি।
আব্বাস ফয়েজ বলেন, শম্পা লাঞ্ছনার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে সরকার কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও অধিকার তা মনিটরিং করবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সরকারগুলো মানবাধিকার রক্ষার কথা মুখে বললেও বাস্তবায়ন করে না। সাতক্ষীরা, খুলনা ও যশোর অঞ্চলে সাংবাদিক শামছুর রহমান, হুমায়ুন কবীর বালু, মানিক সাহা, স ম আলাউদ্দিন, হারুন-অর-রশিদসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। অসংখ্য সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সন্ত্রাসী-গডফাদাররা এসব সাংবাদিক নির্যাতন ও হত্যার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই সাংবাদিক হত্যার বিচার করেনি। মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করতে গিয়ে আজ সাতক্ষীরার শম্পা গোস্বামীকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে অধিকারের প্রেসিডেন্ট প্রফেসর সি আর আবরার, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কর্মসূচির সহকারী টিম মলি নিয়াকস, অধিকারের প্রোগ্রাম অফিসার রুমানা আমান বক্তব্য রাখেন।
ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন তুলে ধরে রুমানা আমান সাংবাদিকদের জানান, খুলনা জেলার পাইকগাছায় গণধর্ষণের শিকার এক মহিলার ঘটনা তদন্তে গিয়ে শম্পা গোস্বামীর সঙ্গে সুশান্ত করের পরিচয় হয়। সুশান্ত নিজেকে একজন বন্ধকি ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেন। ধর্ষণের ভিকটিম প্রথমে এ ব্যাপারে কথা বলতে অস্বস্তিবোধ করেন। সুশান্তও এ বিষয়টি চেপে যেতে চাপ সৃষ্টি করেন। শম্পা গোস্বামী কারও কথায় কান না দিয়ে আইনের আশ্রয় নেয়ার জন্য ভিকটিমকে পরামর্শ দেন। ভিকটিম শম্পা গোস্বামীর মোবাইল নম্বরটি চেয়ে নেন। এ সময় সুশান্ত করও নম্বরটি টুকে নেন। শম্পা পরে জানতে পারেন, ভিকটিম ধর্ষকদের বিরুদ্ধে পাইকগাছা থানায় মামলা করেছেন। ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত সুশান্ত করের কয়েকজন আত্মীয়কেও আসামি করা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হন সুশান্ত। তিনি মামলাটি তুলে নেয়ার জন্য শম্পা গোস্বামীকে চাপ দেন। শম্পা এ বিষয়ে তার কিছুই করার নেই বলে জানান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সুশান্ত তাকে দেখে নেয়ার হুমকি দেন। গত ২৩ অক্টোবর দুপুরে অধিকার থেকে পাঠানো কিছু কাগজপত্র ডিসি অফিসে জমা দিতে যাওয়ার পথে সূচনা বেকারির সামনে প্রথমে ৪-৫ যুবক এসে শম্পা গোস্বামীকে উদ্দেশ করে কুরুচিপূর্ণ কথা বলতে থাকে। এর কয়েক মিনিট পর তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সুশান্ত ও সমীর দে। একপর্যায়ে পুলিশি সহায়তা নিতে শম্পা মোবাইল হাতে নিলে এক যুবক এসে ফোনটি ছিনিয়ে নেয় এবং তাকে একটি দোকানের ছাদে নিয়ে যায়। পরে একজন সাংবাদিক এসে তাকে উদ্ধার করেন। বিষয়টি থানাকে অবহিত করা হয়। ২৫ অক্টোবর সাতক্ষীরা সদর থানায় একটি মামলা করেন শম্পা। মামলার অন্যতম আসামি সমীর দে’কে ২৮ অক্টোবর পুলিশ গ্রেফতার করে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সুশান্ত কর ৩০ অক্টোবর শম্পা গোস্বামীকে মোবাইলে ফোন করে জানায়, সমীরের জামিনের ব্যবস্থা না করলে তাকে দেখে নেবে। সে সময় সে ভারত থেকে ফোন করেছে বলে জানায় ।
এ ঘটনার পর শম্পা গোস্বামী যে স্কুলে শিক্ষকতা করেন ওই স্কুল কর্তৃপক্ষ তার পাশে না দাঁড়িয়ে উল্টো চাকরিচ্যুতির হুমকি দেয়। ৩ নভেম্বর স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শাহাদাত হোসেন সভা ডাকেন। সভায় শম্পাকে ডেকে নিয়ে তিরস্কার করেন এবং কেন অধিকারের কাজে শহরে গেলেন, সেজন্য কৈফিয়ত তলব করেন। থানায় মামলা করায় বকাবকি করে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বলেন, সমীর আমার প্রতিবেশী ও রাজনৈতিক দলের কর্মী। আপনি কোন সাহসে তার বিরুদ্ধে মামলা করলেন। তিনি ঘটনা তদন্তে নিজেই একটি কমিটি গঠন করে বলেন, তদন্ত টিম আপনার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে আপনাকে চাকরিচ্যুত করা হবে। এরপর তাকে তিরস্কার করে মিটিং থেকে বের করে দেন। ওইদিনই সমীর দে জামিনে মুক্তি পেয়ে এলাকার বখাটেদের সঙ্গে নিয়ে শম্পার বিরুদ্ধে কুত্সা রটাতে থাকে এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের শম্পার ক্লাস বর্জন করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। ১১ নভেম্বর সমীর দে তার এক বন্ধুর মাধ্যমে মামলা তুলে না নিলে উচিত শিক্ষা দেবে বলে হুমকি দেয়।
প্রফেসর সি আর আবরার সাংবাদিকদের জানান, বর্তমানে শম্পা চরম নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি চাকরি থেকে বরখাস্তের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। আবরার শম্পা গোস্বামীর নিরাপত্তা ও লাঞ্ছনাকারীদের বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানান।