Wednesday 29 December 2010

পুলিশের কাজে বাধাদান’ : বিরোধী নেতাকর্মীদের ফাঁসানোর নতুন অস্ত্র


নাছির উদ্দিন শোয়েব
তুচ্ছ ঘটনা নিয়েও এখন দেশে মামলা হচ্ছে। পুলিশের দায়িত্ব পালনে বাঁধা দেয়ার অভিযোগ এনে মামলা করে আসামি করা হচ্ছে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের। বিরোধী মতের লোকজনকে এসব মামলায় ফাঁসিয়ে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করা হচ্ছে। এমনকি আদালতের পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ হানা দিয়ে যে কাউকে গ্রেফতার করছে। যাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে ওই ব্যক্তি পুলিশের কাজে বাধা তো দূরের কথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘটনা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। এমনকি ঘটনাস্থলেও তিনি উপস্থিত ছিলেন না। অথচ মামলার আসামি হচ্ছেন তিনি। পুলিশের এ ধরনের মামলায় নাজেহাল হচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু সরকারি দলের এমপি ও ক্যাডাররা যখন পুলিশের ওপর হামলা চালায়, থানার ওসিকে চড়থাপ্পড় দেয়, থানার ভেতরে ঢুকে পুলিশকে হুমকি দেয়, আসামি ছিনিয়ে নেয় তখন পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার মামলা হয় না। দু’একটি মামলা হলেও কেউ গ্রেফতার হয় না।
এ ব্যাপারে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া জানান, পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার ঘটনায় দায়ের করা অধিকাংশ মামলা আদালতে টেকে না। কারণ এসব মামলার বেশিরভাগই অসত্য। মিথ্যা এজাহার দাখিল করায় আদালতে আসামি খালাস পেয়ে যায়। তিনি বলেন, পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার ঘটনায় দণ্ডবিধির ৩৩২, ৩৩৩ ও ৩৫৩ ধারায় মামলা করা যায়। এ মামলায় সর্বোচ্চ ৩ বছর সাজা দেয়ার বিধান রয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বর্তমানে আদালত এসব মালায়ও দফায় দফায় রিমান্ড মঞ্জুর করছেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ডিসি মনিরুল ইসলাম বলেন, মিথ্যা অভিযোগে এখন পর্যন্ত মামলা করার কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় বিচারক আসামির রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই। তিনি আরও বলেন, রিমান্ডে এনে গোয়েন্দা কার্যালয়ে কাউকে নির্যাতন করা হয়েছে এ কথা কেউ বলতে পারবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার ঘটনায় বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া এজাহারগুলোর বেশিরভাগই অসত্য। প্রতিপক্ষের লোকজনকে ঘায়েল করতে পুলিশকে দিয়ে ফরমায়েশি মামলা করানো হয়। রাজনৈতিক প্ররোচনায় এর কলকাঠি নাড়ছেন পুলিশের ঊর্ধতন কিছু কর্মকর্তা। পুলিশকে দিয়ে সাজানো মামলা করে প্রতিপক্ষকে সহজেই ঘায়েল করার কৌশল নেয়া হচ্ছে। ফলে অনেক মামলাই তত্ক্ষণাত্ দায়ের করা হয় না। ঊর্ধ্বতন মহলের ইঙ্গিতে মামলাগুলো দায়ের করা হয়। কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের সময় তার পক্ষের লোকজন বিক্ষোভ মিছিল করলেও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে মামলা হয়। এমনকি আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে বিচারকের এজলাসে থাকা অবস্থায় বাইরে বিক্ষোভের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আটক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে এমন নজিরও রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাষ্ট্রের কল্যাণে প্রশাসন বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ করে থাকে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, অপরাধীকে আইনের হাতে সোপর্দ করা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর রুটিন ওয়ার্ক। এ ছাড়াও দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে এ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ভূমিকা, বিশৃঙ্খলা ও সন্ত্রাস দমন এবং উগ্রবাদ নির্মূলে সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান বাধা দিলেই কেবল পুলিশের কাজে বাধা দেয়া হয়। অন্যথায় নয়। সঠিক তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে হয়রানি করা নিশ্চয়ই পুলিশের কাজ নয়। আদালতের রায় কিংবা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই কেবল আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের হয়রানি করতে পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার কাল্পনিক কাহিনী ফেঁদে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হচ্ছে এমন বহু অভিযোগ রয়েছে। রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার রহস্য উদঘাটনের জন্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত জুনে দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগ এনে কাল্পনিক মামলা দায়ের করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। মধ্যরাতে পুলিশ আমার দেশ সম্পাদককে গ্রেফতার করতে গেলে কর্মরত সাংবাদিকরা ওয়ারেন্ট দেখতে চান। এ নিয়ে সাংবাদিক ও পুলিশের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয় এবং জোরপূর্বক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করতে চাইলে সাংবাদিকরা প্রতিবাদ করেন। পরে পত্রিকার প্রকাশক হাসমত আলীর অভিযোগ থেকে খালাস পেলেও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে মাহমুদুর রহমানকে আসামি করা হয় এবং কর্মরত ৫ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। এ মামলায় মাহমুদুর রহমানকে রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালায় পুলিশ। এরপর মাহমুদুর রহমানকে আদালতে হাজির করার সময় আইনজীবীদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ বাধা দিলে সেখানে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এতেও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে মামলা হয়।
গত ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং দলের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বেআইনি সমাবেশ, পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেয়া, পুলিশকে মারধর এবং ভাংচুরের অভিযোগে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এসব মামলা করা হয়। জামায়াতের তিন নেতাকে পল্টন থানায় দায়ের করা তিনটি মামলায় তিন দিন করে রিমান্ড আদেশ দেন আদালত। মামলায় এ তিন নেতার নাম না থাকলেও জামায়াত-শিবিরের সমাবেশে উপস্থিত থেকে এসব ঘটনা ঘটান বলে রিমান্ড আবেদনে উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও গত ২৭ জুন হরতালে জামায়াত নেতাকর্মীরা পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেন এবং পুলিশের ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে পুলিশ সদস্যদের আহত করার অভিযোগ এনে রমনা থানায় ওইদিনই মামলা করা হয়। মামলায় এ তিন নেতার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে উল্লেখ করে রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ।
২৭ জুন হরতালে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ভাংচুর, সরকারকে অস্থিতিশীল করা এবং হত্যার উদ্দেশ্যে পুলিশকে গলা চেপে ধরার অপরাধে বিএনপি নেতা শমসের মুবিন চৌধুরী, মোস্তফা আহম্মেদ, মো. এলাহী, মো. বাবুল, সুলতান আহম্মেদ, মতিউর রহমান এলাহী এবং মো. মুসা কলিমুল্লাকে আসামি করে গুলশান থানায় মামলা করা হয় এবং তাদের রিমান্ডে নেয়া হয়।
১৬ নভেম্বর রাজধানীর গাবতলী মোড়ে ট্রাফিক কনস্টেবলকে মারধর করে আহত করা, পুলিশের দায়িত্ব পালনে বাধা এবং আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে চলচ্চিত্র অভিনেতা এবং ডিসিসির ৯ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার মনোয়ার হোসেন ডিপজলের বিরুদ্ধে দারুস সালাম থানায় মামলা করে পুলিশ। ২৮ নভেম্বর ডিপজল থানায় আত্মসমর্পণ করেন। এ মামলায় তাকে দুই দফা রিমান্ডে নেয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদে ট্রাফিক পুলিশকে মারধর এবং অস্ত্র দেখানোর বিষয়টি অস্বীকার করে ডিপজল বলেছেন, আলতাব হোসেন নামে ট্রাফিক পুলিশের ওই সদস্যের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়েছে। তিনি কাউকে মারধর করেননি বা অস্ত্র প্রদর্শন করেননি।
গত ২০ ডিসেম্বর বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া চীন যাওয়ার সময় হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে দলের নেতাদের হাতাহাতির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় একটি মামলা হয়েছে। শনিবার এ ঘটনা ঘটলেও একদিন পর রোববার রাতে মামলা করা হয়। মামলায় বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাজিম উদ্দিন আলম ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেলসহ ৬ নেতাকে আসামি করা হয়েছে। সিভিল অ্যাভিয়েশন নিরাপত্তা বিভাগের উপ-পরিচালক তোফাজ্জল হোসেন বাদী হয়ে এ মামলা করেন। এ ঘটনায় বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বলেন, বিমানবন্দরে বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা অশোভন আচরণ করে উল্টো তারাই আবার মামলা করেছে।
ভিন্ন চিত্র : কিছুদিন আগে যশোরের শার্শা থানার এমপি শেখ আফিল উদ্দিন তার অনুমতি না নিয়ে হত্যা মামলা নেয়ায় থানার ওসিকে ডেকে নিয়ে পিটিয়েছেন বলে জানা গেছে। ওসির জামার কলার ধরে বেধড়ক পিটিয়ে কক্ষের মেঝেতে ফেলে কিল, ঘুষি, লাথি, থাপ্পড় মারে এমপির ক্যাডাররা। এছাড়াও এমপির খেদোক্তি ছিল আজ জানে মারলাম না, আমার কথামত কাজ না করলে মেরেই ফেলব। এ ঘটনার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওসিকে এলাকা ছেড়ে চলে যেতেও নির্দেশ দেন শেখ আফিল উদ্দিন। বিএনপি কর্মী আবদুল হামিদ খুন হওয়ার ঘটনায় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়। পুলিশ ওই মামলার এজাহারভুক্ত এক আসামিকে গ্রেফতার করে। আর এতেই ক্ষিপ্ত হন এমপি শেখ আফিল উদ্দিন। ওসি এনামুল হক পরে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, বাসা থেকে ডেকে এনে এমপি আমাকে প্রথমে দু’তিনটি থাপ্পড় মারেন। আর এমপির ক্যাডার ঝিকরগাছার মুছা মাহমুদ আমার ইউনিফর্মের কলার চেপে ধরে তলপেটে দু’তিনটি লাথি মারে। এ সময় আমি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে মুছা লাথি মারতে মারতে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। গত মে মাসে পুরনো ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে মোটরসাইকেলের কাগজপত্র চেক করতে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতার তোপের মুখে পড়েন সূত্রাপুর থানার এএসআই সাইফুর রহমান। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ওই নেতার মোটরসাইকেলের কাগজপত্র দেখতে চান তিনি। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হলে সাইফুর রহমানকে টেনেহিঁচড়ে ক্যাম্পাসে নিয়ে একটি রুমে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়।
১৭ জুলাই কামরাঙ্গীরচর থানার লোহার ব্রিজের ঢালে চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনকালে এসআই এবারত হোসেন কাগজপত্রবিহীন একটি মোটরসাইকেল আটক করে। ওই মোটরসাইকেলটি ছাড়িয়ে নিতে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা জুম্মন ও মোহাম্মদ আলী পলাশ ঘটনাস্থলে আসে। এর আগে জুম্মন মোটর সাইকেলটি ছেড়ে দিতে পুলিশকে নির্দেশ দেয়। তার নির্দেশ অমান্য করায় ওই দুই নেতাসহ ১০-১৫ সন্ত্রাসী এসআই এবারত হোসেনকে মারধর করে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা কলেজের সামনে এক সার্জেন্টকে বেদম পেটায় কয়েক ছাত্রলীগ ক্যাডার। সম্প্রতি রাজধানীতে এক এমপির পিএস’র হাতে লাঞ্ছিত হন এক পুলিশ কর্মকর্তা। এর আগেও সংসদ সদস্যের হাতে পুলিশ মার খেয়েছে। ওইসব ঘটনার বিচার তো হয়নি বরং মামলা হওয়ায় পুলিশ কর্মকর্তাদের ক্ষমা চাইতে হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পুলিশের ওপর সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের এ নির্যাতন পুলিশের কাজে বাধার মধ্যে পড়ে না। দু’একটি ঘটনায় মামলা হলেও কোনো প্রকার অ্যাকশনে যায়নি পুলিশ প্রশাসন।

পুলিশের কাজে বাধাদান’ : বিরোধী নেতাকর্মীদের ফাঁসানোর নতুন অস্ত্র


নাছির উদ্দিন শোয়েব
তুচ্ছ ঘটনা নিয়েও এখন দেশে মামলা হচ্ছে। পুলিশের দায়িত্ব পালনে বাঁধা দেয়ার অভিযোগ এনে মামলা করে আসামি করা হচ্ছে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের। বিরোধী মতের লোকজনকে এসব মামলায় ফাঁসিয়ে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করা হচ্ছে। এমনকি আদালতের পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ হানা দিয়ে যে কাউকে গ্রেফতার করছে। যাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে ওই ব্যক্তি পুলিশের কাজে বাধা তো দূরের কথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘটনা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। এমনকি ঘটনাস্থলেও তিনি উপস্থিত ছিলেন না। অথচ মামলার আসামি হচ্ছেন তিনি। পুলিশের এ ধরনের মামলায় নাজেহাল হচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু সরকারি দলের এমপি ও ক্যাডাররা যখন পুলিশের ওপর হামলা চালায়, থানার ওসিকে চড়থাপ্পড় দেয়, থানার ভেতরে ঢুকে পুলিশকে হুমকি দেয়, আসামি ছিনিয়ে নেয় তখন পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার মামলা হয় না। দু’একটি মামলা হলেও কেউ গ্রেফতার হয় না।
এ ব্যাপারে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া জানান, পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার ঘটনায় দায়ের করা অধিকাংশ মামলা আদালতে টেকে না। কারণ এসব মামলার বেশিরভাগই অসত্য। মিথ্যা এজাহার দাখিল করায় আদালতে আসামি খালাস পেয়ে যায়। তিনি বলেন, পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার ঘটনায় দণ্ডবিধির ৩৩২, ৩৩৩ ও ৩৫৩ ধারায় মামলা করা যায়। এ মামলায় সর্বোচ্চ ৩ বছর সাজা দেয়ার বিধান রয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বর্তমানে আদালত এসব মালায়ও দফায় দফায় রিমান্ড মঞ্জুর করছেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ডিসি মনিরুল ইসলাম বলেন, মিথ্যা অভিযোগে এখন পর্যন্ত মামলা করার কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় বিচারক আসামির রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই। তিনি আরও বলেন, রিমান্ডে এনে গোয়েন্দা কার্যালয়ে কাউকে নির্যাতন করা হয়েছে এ কথা কেউ বলতে পারবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার ঘটনায় বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া এজাহারগুলোর বেশিরভাগই অসত্য। প্রতিপক্ষের লোকজনকে ঘায়েল করতে পুলিশকে দিয়ে ফরমায়েশি মামলা করানো হয়। রাজনৈতিক প্ররোচনায় এর কলকাঠি নাড়ছেন পুলিশের ঊর্ধতন কিছু কর্মকর্তা। পুলিশকে দিয়ে সাজানো মামলা করে প্রতিপক্ষকে সহজেই ঘায়েল করার কৌশল নেয়া হচ্ছে। ফলে অনেক মামলাই তত্ক্ষণাত্ দায়ের করা হয় না। ঊর্ধ্বতন মহলের ইঙ্গিতে মামলাগুলো দায়ের করা হয়। কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের সময় তার পক্ষের লোকজন বিক্ষোভ মিছিল করলেও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে মামলা হয়। এমনকি আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে বিচারকের এজলাসে থাকা অবস্থায় বাইরে বিক্ষোভের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আটক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে এমন নজিরও রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাষ্ট্রের কল্যাণে প্রশাসন বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ করে থাকে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, অপরাধীকে আইনের হাতে সোপর্দ করা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর রুটিন ওয়ার্ক। এ ছাড়াও দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে এ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ভূমিকা, বিশৃঙ্খলা ও সন্ত্রাস দমন এবং উগ্রবাদ নির্মূলে সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান বাধা দিলেই কেবল পুলিশের কাজে বাধা দেয়া হয়। অন্যথায় নয়। সঠিক তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে হয়রানি করা নিশ্চয়ই পুলিশের কাজ নয়। আদালতের রায় কিংবা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই কেবল আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের হয়রানি করতে পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার কাল্পনিক কাহিনী ফেঁদে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হচ্ছে এমন বহু অভিযোগ রয়েছে। রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার রহস্য উদঘাটনের জন্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত জুনে দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগ এনে কাল্পনিক মামলা দায়ের করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। মধ্যরাতে পুলিশ আমার দেশ সম্পাদককে গ্রেফতার করতে গেলে কর্মরত সাংবাদিকরা ওয়ারেন্ট দেখতে চান। এ নিয়ে সাংবাদিক ও পুলিশের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয় এবং জোরপূর্বক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করতে চাইলে সাংবাদিকরা প্রতিবাদ করেন। পরে পত্রিকার প্রকাশক হাসমত আলীর অভিযোগ থেকে খালাস পেলেও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে মাহমুদুর রহমানকে আসামি করা হয় এবং কর্মরত ৫ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। এ মামলায় মাহমুদুর রহমানকে রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালায় পুলিশ। এরপর মাহমুদুর রহমানকে আদালতে হাজির করার সময় আইনজীবীদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ বাধা দিলে সেখানে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এতেও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে মামলা হয়।
গত ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং দলের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বেআইনি সমাবেশ, পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেয়া, পুলিশকে মারধর এবং ভাংচুরের অভিযোগে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এসব মামলা করা হয়। জামায়াতের তিন নেতাকে পল্টন থানায় দায়ের করা তিনটি মামলায় তিন দিন করে রিমান্ড আদেশ দেন আদালত। মামলায় এ তিন নেতার নাম না থাকলেও জামায়াত-শিবিরের সমাবেশে উপস্থিত থেকে এসব ঘটনা ঘটান বলে রিমান্ড আবেদনে উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও গত ২৭ জুন হরতালে জামায়াত নেতাকর্মীরা পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেন এবং পুলিশের ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে পুলিশ সদস্যদের আহত করার অভিযোগ এনে রমনা থানায় ওইদিনই মামলা করা হয়। মামলায় এ তিন নেতার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে উল্লেখ করে রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ।
২৭ জুন হরতালে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ভাংচুর, সরকারকে অস্থিতিশীল করা এবং হত্যার উদ্দেশ্যে পুলিশকে গলা চেপে ধরার অপরাধে বিএনপি নেতা শমসের মুবিন চৌধুরী, মোস্তফা আহম্মেদ, মো. এলাহী, মো. বাবুল, সুলতান আহম্মেদ, মতিউর রহমান এলাহী এবং মো. মুসা কলিমুল্লাকে আসামি করে গুলশান থানায় মামলা করা হয় এবং তাদের রিমান্ডে নেয়া হয়।
১৬ নভেম্বর রাজধানীর গাবতলী মোড়ে ট্রাফিক কনস্টেবলকে মারধর করে আহত করা, পুলিশের দায়িত্ব পালনে বাধা এবং আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে চলচ্চিত্র অভিনেতা এবং ডিসিসির ৯ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার মনোয়ার হোসেন ডিপজলের বিরুদ্ধে দারুস সালাম থানায় মামলা করে পুলিশ। ২৮ নভেম্বর ডিপজল থানায় আত্মসমর্পণ করেন। এ মামলায় তাকে দুই দফা রিমান্ডে নেয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদে ট্রাফিক পুলিশকে মারধর এবং অস্ত্র দেখানোর বিষয়টি অস্বীকার করে ডিপজল বলেছেন, আলতাব হোসেন নামে ট্রাফিক পুলিশের ওই সদস্যের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়েছে। তিনি কাউকে মারধর করেননি বা অস্ত্র প্রদর্শন করেননি।
গত ২০ ডিসেম্বর বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া চীন যাওয়ার সময় হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে দলের নেতাদের হাতাহাতির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় একটি মামলা হয়েছে। শনিবার এ ঘটনা ঘটলেও একদিন পর রোববার রাতে মামলা করা হয়। মামলায় বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাজিম উদ্দিন আলম ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেলসহ ৬ নেতাকে আসামি করা হয়েছে। সিভিল অ্যাভিয়েশন নিরাপত্তা বিভাগের উপ-পরিচালক তোফাজ্জল হোসেন বাদী হয়ে এ মামলা করেন। এ ঘটনায় বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বলেন, বিমানবন্দরে বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা অশোভন আচরণ করে উল্টো তারাই আবার মামলা করেছে।
ভিন্ন চিত্র : কিছুদিন আগে যশোরের শার্শা থানার এমপি শেখ আফিল উদ্দিন তার অনুমতি না নিয়ে হত্যা মামলা নেয়ায় থানার ওসিকে ডেকে নিয়ে পিটিয়েছেন বলে জানা গেছে। ওসির জামার কলার ধরে বেধড়ক পিটিয়ে কক্ষের মেঝেতে ফেলে কিল, ঘুষি, লাথি, থাপ্পড় মারে এমপির ক্যাডাররা। এছাড়াও এমপির খেদোক্তি ছিল আজ জানে মারলাম না, আমার কথামত কাজ না করলে মেরেই ফেলব। এ ঘটনার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওসিকে এলাকা ছেড়ে চলে যেতেও নির্দেশ দেন শেখ আফিল উদ্দিন। বিএনপি কর্মী আবদুল হামিদ খুন হওয়ার ঘটনায় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়। পুলিশ ওই মামলার এজাহারভুক্ত এক আসামিকে গ্রেফতার করে। আর এতেই ক্ষিপ্ত হন এমপি শেখ আফিল উদ্দিন। ওসি এনামুল হক পরে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, বাসা থেকে ডেকে এনে এমপি আমাকে প্রথমে দু’তিনটি থাপ্পড় মারেন। আর এমপির ক্যাডার ঝিকরগাছার মুছা মাহমুদ আমার ইউনিফর্মের কলার চেপে ধরে তলপেটে দু’তিনটি লাথি মারে। এ সময় আমি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে মুছা লাথি মারতে মারতে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। গত মে মাসে পুরনো ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে মোটরসাইকেলের কাগজপত্র চেক করতে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতার তোপের মুখে পড়েন সূত্রাপুর থানার এএসআই সাইফুর রহমান। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ওই নেতার মোটরসাইকেলের কাগজপত্র দেখতে চান তিনি। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হলে সাইফুর রহমানকে টেনেহিঁচড়ে ক্যাম্পাসে নিয়ে একটি রুমে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়।
১৭ জুলাই কামরাঙ্গীরচর থানার লোহার ব্রিজের ঢালে চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনকালে এসআই এবারত হোসেন কাগজপত্রবিহীন একটি মোটরসাইকেল আটক করে। ওই মোটরসাইকেলটি ছাড়িয়ে নিতে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা জুম্মন ও মোহাম্মদ আলী পলাশ ঘটনাস্থলে আসে। এর আগে জুম্মন মোটর সাইকেলটি ছেড়ে দিতে পুলিশকে নির্দেশ দেয়। তার নির্দেশ অমান্য করায় ওই দুই নেতাসহ ১০-১৫ সন্ত্রাসী এসআই এবারত হোসেনকে মারধর করে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা কলেজের সামনে এক সার্জেন্টকে বেদম পেটায় কয়েক ছাত্রলীগ ক্যাডার। সম্প্রতি রাজধানীতে এক এমপির পিএস’র হাতে লাঞ্ছিত হন এক পুলিশ কর্মকর্তা। এর আগেও সংসদ সদস্যের হাতে পুলিশ মার খেয়েছে। ওইসব ঘটনার বিচার তো হয়নি বরং মামলা হওয়ায় পুলিশ কর্মকর্তাদের ক্ষমা চাইতে হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পুলিশের ওপর সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের এ নির্যাতন পুলিশের কাজে বাধার মধ্যে পড়ে না। দু’একটি ঘটনায় মামলা হলেও কোনো প্রকার অ্যাকশনে যায়নি পুলিশ প্রশাসন।

রিমান্ডে নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন সা. কাদের চৌধুরী

নাছির উদ্দিন শোয়েব

ডিবি কার্যালয়ে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে দুটি গোয়েন্দা সংস্থার ৮ সদস্য অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পাঁচ দিনের রিমান্ডে ডিবি কর্মকর্তারা তাকে তেমন কোনো জিজ্ঞাসাবাদ না করলেও গভীর রাতে অন্য সংস্থার লোকজন এসে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। নাকে ঘুষি দিয়ে তাকে রক্তাক্ত করা হয়। বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়। পায়ের নিচে শক্ত লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়। শরীরে ইনজেকশন পুশ করা হয়। এ ছাড়াও তাকে বিভিন্ন হুমকি দিয়ে মানসিকভাবে দুর্বল করার চেষ্টা করেছে তারা। একপর্যায়ে তাকে এই বলে হুমকি দেয়া হয়েছে, ‘ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমকে পেটের নাড়িভুঁড়ি বের করে যেভাবে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে, তোর পরিণতিও ঠিক একই রকম হবে।’ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী নাকের রক্ত যে টিস্যু দিয়ে মুছেছেন সেই টিস্যুটি তিনি তার পরিবারের কাছে সরবরাহ করেন। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পারিবারিক সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
২৬ জুন মগবাজারে গাড়ি পোড়ানো মামলায় পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গতকাল সিএমএম আদালতে হাজির করা হয়। আদালতের অনুমতি নিয়ে দুপুরে পরিবারের তিন সদস্য এবং তিন আইনজীবী তার সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। সাক্ষাত্কারীরা হচ্ছেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী, বড় ছেলে ফাইয়াজ কাদের চৌধুরী, ছোট ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী, আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার ডালিয়া চৌধুরী (বড় ছেলের স্ত্রী) এবং অ্যাডভোকেট আবু জাফর মানিক। চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে তারা আদালতের হাজতখানায় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। এসময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে তারা কোনো খাবার সরবরাহ করতে পারেননি। ফল, বিস্কুট ও পারিবারিকভাবে কিছু খাবার নিয়ে গেলেও পুলিশ তা সরবরাহ করতে দেয়নি বলে জানা গেছে।
এদিকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিচারকাজ পর্যবেক্ষণে দুপুরে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের দুই কূটনীতিক আদালতে যান। দুপুর ১টায় মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা পোলিয়ার ফরেস্ট গ্রাহাম ও সহকারী রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ লুবেন চৌধুরী মাসুম আদালতে পৌঁছান। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবীর মাধ্যমে তারা আদালতের অনুমতি চাইলেও তাদের হাজতখানায় বিএনপি নেতার সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়নি। সূত্র জানায়, ওই দুই মার্কিন কূটনৈতিক স্বেচ্ছায় বিচারকাজ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিলেন। সাক্ষাতের অনুমতি না পেয়ে পরিবারের কাছ থেকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রিমান্ড, নির্যাতন এবং তার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। এর প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট দফতরে উপস্থাপন করা হবে বলে তারা পরিবারকে জানিয়েছেন।
পারিবারিক সূত্র জানায়, গত ১৬ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী থেকে গ্রেফতার হওয়ার পর গতকালই প্রথম পরিবারের লোকজনের সাক্ষাত্ পেলেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। বেলা আড়াইটার দিকে আদালতের হাজতখানায় পরিবারের সদস্যদের কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। এসময় এক আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। গ্রেফতারের পর ৬ দিনে তার জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া দুঃসহ দিনগুলোর কথা তুলে ধরেন তিনি। ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মানসিক অবস্থা এখনও আগের মতোই আছে। তিনি ভেঙে পড়েননি। তিনি স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে এবং পরিবারের উদ্দেশে বলেছেন, তার মনোবল অটুট আছে, থাকবে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তাদের বলেছেন, ‘আমাকে সাফ করে দেয়া এতটা সহজ নয়। দল যদি পাশে থাকে ওরা আমার কিছুই করতে পারবে না।’ এসময় পরিবারের সদস্যরা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ম্যাডামের কাছে (বিরোধীদলীয় নেতা) আপনার সব খবর আছে। আপনাকে গ্রেফতার এবং নির্যাতনের বিষয় নিয়ে দলীয় পক্ষ থেকে কর্মসূচি চলছে। সাধারণ মানুষ সরকারের এসব বিষয় ভালোভাবে নেয়নি বলেও তাকে অবহিত করা হয়েছে। পরিবারের কাছ থেকে এসব কথা শুনে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মনোবল আরও দৃঢ় হয়েছে বলে জানা যায়।
পারিবারিক সূত্র জানায়, হাজতখানায় ৩০ মিনিটের সাক্ষাতে বেশিরভাগ সময়েই তিনি তার ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। এসময় তার পা ফোলা এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। তিনি বলেছেন, গ্রেফতারের পরপরই আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কিছু সদস্য তার ওপর নির্যাতন শুরু করে। এরপর ক্যান্টনমেন্ট থানায় নিয়ে পায়ের এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত করা হয়। শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্লেড দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। এরপর ডিবি কার্যালয়ে রিমান্ডে নিয়েও তার ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। তিনি বলেন, ৫ দিনের রিমান্ডে থাকাকালে ডিবির কর্মকর্তারা তার ওপর নির্যাতন চালায়নি। তদন্ত কর্মকর্তা তার কাছে তেমন কোনো বিষয় জানতেও চায়নি। তবে রাতে দুটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন মাঝেমধ্যেই ডিবি কার্যালয়ে এসে তার ওপর নির্যাতন করেছে। কখনও চোখ বেঁধে, আবার চোখ খোলা রেখে নির্যাতন করেছে। তাদের সংখ্যা হবে ৭-৮ জন। তারা বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে আমাকে মানসিকভাবে দুর্বল করার চেষ্টা করে। শরীরে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়েছে। ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে। নির্যাতনে আমার চোখ দিয়ে পানি বের না হওয়ায় তারা অবাক হয়ে বলে, তুই তো কঠিন মানুষ। চোখে এক ফোঁটা পানিও নেই? এরপর তারা হুমকি দিয়ে বলেছে, তোর পরিণতি কী হবে জানি না। ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমকে যেভাবে পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে তোর পরিণতিও হবে সেরকম। এসব কথা শুনে মাঝেমধ্যে ঘাবড়ে গেলেও মানসিকভাবে তাকে দুর্বল করতে পারেনি। এভাবে প্রতিরাতেই বাইরে থেকে লোকজন এসে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন চালিয়েছে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী পরিবারের কাছে আরও বলেন, বাইরে থেকে ওই লোকজন যখনই আসত ডিবির কর্মকর্তারা তখন ওই কক্ষ থেকে চলে যেতেন।

রিমান্ড শেষে আদালতে না তুলেই সা. কাদেরকে জেলে প্রেরণ : শুনানিতে হট্টগোল, বিচার দেখলেন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা



স্টাফ রিপোর্টার
টানা ৫ দিন রিমান্ড শেষে বিএনপি নেতা ও বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গতকাল কারাগারে পাঠানো হয়েছে। শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য তাকে আদালতে হাজির করা নিয়ে উভয় পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে তুমুল হট্টগোল, বাকবিতণ্ডা ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। শেষ পর্যন্ত তাকে আদালতে হাজির না করেই জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়া হয়। একই সঙ্গে আদালত তাকে উন্নত চিকিত্সা এবং কারাগারে প্রথম শ্রেণীর কয়েদির মর্যাদা দেয়ার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেন। আদালতে উপস্থিত থেকে আইনজীবীদের শুনানি ও বিচার কাজ পর্যবেক্ষণ করেন মার্কিন দূতাবাসসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তারা। তবে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে আইনজীবীসহ পর্যবেক্ষকদের কাউকেই দেখা করতে দেয়া হয়নি। শুনানিকালে তার মুক্তির দাবিতে আদালত চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল করার সময় ছাত্রদল ও যুবদল নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশ এবং ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। মিছিল থেকে পুলিশ ছাত্রদলের ১০ নেতাকে আটক করে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে গেছে।
রিমান্ডে নিয়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ওপর বর্বর নির্যাতন ও অমানবিক আচরণ করা হয়েছে বলে তার আইনজীবীরা সাংবাদিক ও বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে অভিযোগ করেছেন। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমদ তালুকদার বলেন, নির্যাতন করে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জীবন বিপন্ন করে দেয়া হয়েছে। এ কারণেই তাকে কোর্ট হাজত থেকে আদালতে তুলতে দেয়নি সরকার পক্ষ। কোর্ট হাজতে রেখেই পরে তাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গত ১৬ ডিসেম্বর ভোররাতে র্যাব ও পুলিশ আটক করার পর ওইদিনই তাকে মগবাজারে একটি গাড়িতে আগুন দেয়ার কথিত অভিযোগে দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ড নেয় ডিবি পুলিশ।
আদালতে তুমুল হট্টগোল : সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গতকাল একটি প্রিজন ভ্যানে করে ডিবি কার্যালয় থেকে কড়া পুলিশি প্রহরায় কোর্ট হাজতে নেয়া হয় বেলা আড়াইটার দিকে। বেলা পৌনে তিনটার দিকে মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তফা শাহরিয়ার খানের আদালতে শুনানি শুরু হলে অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমদ তালুকদার সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে কোর্ট হাজত থেকে আদালতে উঠানোর জন্য আবেদন করে বলেন, ৫ দিন রিমান্ডে রেখে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। গ্রেফতারের দিন থেকে তার সঙ্গে পরিবারের সদস্য তো দূরের কথা, কোনো আইনজীবীকেও দেখা করতে দেয়া হয়নি। ডিবি কার্যালয় থেকে তাকে কোর্ট হাজতে এনে রাখা হয়েছে। তাকে আদালতে তোলা হলে তার ওপর কি নির্মম নির্যাতন করা হয়েছে তা আদালত পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। রিমান্ড ফেরত আসামিদের আদালতে উপস্থাপন করে বিচারক তার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের বিষয়ে উচ্চ আদালতেরও নির্দেশনা রয়েছে। তার ওপর নির্যাতনে পরিবারের সদস্যরা উদ্বিগ্ন। আমরাও তার জীবন নিয়ে শঙ্কিত। আমরা চাই আইনের বিধান মেনেই তাকে আদালতে তোলা হোক। অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমদের এ আবেদনের বিরোধিতা করে সরকার পক্ষ ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা একযোগে চিত্কার করে বলতে থাকেন, আসামিকে আদালতে না তুলেও শুনানি করা যায়। আসামির ব্যাপারে নতুন করে রিমান্ড চাওয়া হয়নি। এমনকি তাকে নতুন কোনো মামলায় শ্যোন অ্যারেস্টও করা হয়নি। কাজেই তাকে আদালতে তুলে সময় নষ্ট করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। সরকার পক্ষের আইনজীবীদের এ বক্তব্যে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবীরা একযোগে প্রতিবাদ করতে থাকেন। অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমদ তালুকদার বলেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। গত ৩২ বছর ধরে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য। তার মতো একজন জাতীয় ব্যক্তিত্বকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। অথচ এখন সরকার পক্ষ তাকে আদালতে তুলতে বাধা দিচ্ছে। এটা আইনের লঙ্ঘন ও ন্যায়বিচার পরিপন্থী। এ সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম বক্তব্য দিতে চাইলে সরকার পক্ষের ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা একযোগে চিত্কার ও চেঁচামেচি শুরু করে দেন। তারা ফখরুল ইসলামকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি কথা বলতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে আসতে হবে। আপনি মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতীয় বাহিনী নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়েছেন। আপনি তো বাংলাদেশের নাগরিকই নন। এ নিয়ে দ্বিতীয় দফা হইচই শুরু হলে বিচারক এজলাস ত্যাগ করে খাস কামরায় চলে যান। উভয় পক্ষের সিনিয়র আইনজীবীরা পরামর্শ করে পেশকারের মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেটকে আবার এজলাসে আসার অনুরোধ জানান। হট্টগোল থামলে ম্যাজিস্ট্রেট ১০ মিনিট পর আবার এজলাসে এসে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে আদালতে না তুলেই শুনানি করার পরামর্শ দেন আইনজীবীদের।
জামিনের শুনানি : জামিন আবেদন পেশ করে অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমদ তালুকদার আদালতে বলেন, মগবাজারে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে দায়ের করা মামলাটি রাজনৈতিক। এ মামলার ভবিষ্যত্ও রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল। ঘটনার তিনদিন আগে থেকেই সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ঢাকায় ছিলেন না। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামে। সেখান থেকে একটা মানুষের পক্ষে ঢাকার মগবাজারে নিজে সশরীরে হাজির হয়ে গাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনা বিশ্বের কোনো পাগলও বিশ্বাস করবে না। অথচ সরকারের সংশ্লিষ্টরা এটা বিশ্বাসযোগ্য করার চেষ্টা করছেন। এ মামলায় আমরা তার জামিন মঞ্জুরের আবেদন করছি। এ পর্যায়ে আদালত আর কোনো আবেদন আছে কিনা জানতে চান। জবাবে মাসুদ আহমদ তালুকদার বলেন, যদি জামিন নামঞ্জুর হয়, তাহলে কারাগারে তাকে ডিভিশন প্রদান ও উন্নত চিকিত্সা সংক্রান্ত আমাদের আরও দুটি আবেদন রয়েছে।
জামিন আবেদনের বিরোধিতা করে পিপি আবদুল্লাহ আবু আদালতে বলেন, এ মামলায় জামিন মঞ্জুরের কোনো সুযোগ নেই। তার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। এ মামলায় তাকে জামিনে মুক্তি দিলে তিনি পালিয়েও যেতে পারেন। কাজেই তাকে জামিন দেয়া যাবে না। জবাবে মাসুদ আহমদ তালুকদার বলেন, আমরা শুনানি করছি গাড়িতে আগুন দেয়ার মামলা নিয়ে। এখানে অন্য কোনো মামলা বা ইস্যু নিয়ে আসা আইনসম্মত নয়। মূলত বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের রাজনৈতিকভাবে হয়রানির জন্য সরকার প্রহসনের মামলা ও ফরমায়েশি বিচারের আয়োজন করেছে। এ মামলা তারই নিকৃষ্ট প্রমাণ। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরীকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে আদালত কারাগারে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে প্রথম শ্রেণীর কয়েদির মর্যাদা দেয়ার নির্দেশ দেন।
কূটনীতিকদের পর্যবেক্ষণ : সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ওপর অমানবিক নির্যাতনের বিষয়টি দেখা এবং তার বিচার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার জন্য ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের দুইজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অপর একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার একজন প্রতিনিধি গতকাল বেলা ১টায় আদালতে যান। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে কোর্ট হাজত থেকে আদালতে না উঠানোর কারণে তার ওপর কি ধরনের নির্যাতন হয়েছে তা দেখতে পারেননি। আদালতে সরকার পক্ষের বিরোধিতা এবং ছাত্রদল ও আইনজীবীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ, গ্রেফতার ও টানাহেঁচড়ার দৃশ্য তারা প্রত্যক্ষ করেন। গত ১৬ ডিসেম্বর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতারের পর ক্যান্টনমেন্ট ও ডিবি কার্যালয়ে তার ওপর প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়েছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় মার্কিন দূতাবাসসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে দেখা এবং তার বিচার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে আদালতে যান।
১০ নেতাকর্মী গ্রেফতার : সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে আদালতে হাজির করা হবে জেনে দুপুর থেকেই বিএনপি, ছাত্রদল ও যুবদলের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী পুরান ঢাকার কোর্ট এলাকায় সমবেত হন। তারা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মুক্তি দাবি করে স্লোগান দেন। একই সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগেরও বেশ কিছুসংখ্যক নেতাকর্মী জড়ো হয়ে তার শাস্তি দাবিতে মিছিল করে। পুলিশ ছাত্রদল ও যুবদলের মিছিলে লাঠিচার্জ করে আদালত চত্বর থেকে সরিয়ে দিয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের জায়গা করে দেয়। এ নিয়ে ত্রিমুখী সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। পুলিশের সঙ্গে যোগ দিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরাও বিএনপির মিছিলে হামলা করে। এখান থেকে ছাত্রদল ঢাকা মহানগর (দ.) সভাপতি মোহাম্মদ ইসহাক ও কোতোয়ালি থানা সভাপতি মোস্তাক আহমদসহ ১০ জনকে আটক করা হয়। ছাত্রদলের আটককৃত অপর নেতাকর্মীরা হচ্ছেন মানিক হোসেন, মিন্টু, জাহাঙ্গীর হোসেন, শাহ কামাল, মো. জাহাঙ্গীর, জিটু ও ফরিদ। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তাদের কোতোয়ালি থানায় আটক রাখা হয়েছে। কোতোয়ালি থানার ডিউটি অফিসার আমার দেশকে জানান, ওসি সাহেব থানায় এলে আটককৃতদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তাদের কোনো মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট করা হবে, নাকি নতুন মামলা দিয়ে চালান দেয়া হবে তার সিদ্ধান্ত হয়নি।
আদালতে সরকার পক্ষে শুনানি করেন পিপি আবদুল্লাহ আবু, অ্যাডভোকেট আবদুর রহমান হাওলাদার, মুখলেছুর রহমান প্রমুখ। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমদ তালুকদার, মহসিন মিয়া, ওমর ফারুক ফারুকী, মোসলেহউদ্দিন জসিম, খোরশেদ আলম তালুকদার, জয়নাল আবেদীন মেজবাহ প্রমুখ। শুনানির সময় আদালতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েরা উপস্থিত ছিলেন। পরে আদালতের অনুমতি নিয়ে তারা কোর্ট হাজতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন

Tuesday 28 December 2010

মানবাধিকার লঙ্ঘনের বছর




আলাউদ্দিন আরিফ

২০১০ সালের পুরোটাই ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের বছর। রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে ঘটেছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অসংখ্য ঘটনা। হত্যা, অপহরণ ও ক্রসফায়ারসহ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুপ্তহত্যা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়ে অপহরণের পর নিখোঁজ, গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার, মামলা দিয়ে হয়রানি, শ্যোন অ্যারেস্ট, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, নারী নির্যাতন, ইভটিজিং, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর দখল, বিডিআর বিদ্রোহে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে মৃত্যু এবং সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের দলন চলেছে বছরজুড়ে। হত্যা বন্ধের জন্য বিএসএফ প্রধানের একের পর এক প্রতিশ্রুতির পরও সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন একের পর এক বাংলাদেশী নাগরিক।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশজুড়ে অব্যাহতভাবে চলছে ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। যেসব এলাকায় লোকজন ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন তার কোথাও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, বরং অবনতি হয়েছে। এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কেন এসব ক্রসফায়ার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানায়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ—বরাবর এই ঘোষণা দেয়া হলেও তা অব্যাহতভাবেই চলেছে। আত্মরক্ষার্থে গুলিবর্ষণের দোহাই দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যকাণ্ডকে সমর্থন দেয়া হয়েছে। আসকের হিসেব অনুযায়ী চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১১৭ জন ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছে। এই সরকারের সময়ে গুপ্তহত্যা নামে এক ভয়ঙ্কর শব্দ শুনেছে মানুষ। অপহরণের শিকার অনেকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার হয়েছে। আসক আরও জানায়, বছরজুড়েই নাজুক ছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সহিংসতায় একের পর এক মেধাবী ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে। বখাটেদের উত্পাতে কলেজশিক্ষক ও মা-বাবাসহ অনেকে খুন হয়েছেন। হরতালের সময় গ্রেফতারের নামে বিরোধী দলের প্রতিবাদ জানানোর অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সাংবাদিকরা সরকারদলীয় নেতাদের হুমকি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিবিরোধ নিরসন নিয়ে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা, রূপগঞ্জে সেনা হাউজিং প্রকল্প নিয়ে সৃষ্ট সহিংসতা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় আসকের রিপোর্টে।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকার বলেছে, চলতি বছর প্রতি তিন দিনে একজন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। প্রতি চার দিনে একজন বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হয়েছেন বিএসএফের গুলিতে। আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করা, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার ও কারাদণ্ড, বিশেষ প্রতিনিধি অলিউল্লাহ নোমানের কারাদণ্ড, চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়া, সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেস বুক বন্ধ করা, ক্রসফায়ারসংক্রান্ত আলোকচিত্র বন্ধ করে দেয়া, গণমাধ্যমের স্বাধীনতাহরণ, সন্ত্রাস দমন আইন ২০০৯-এ নির্যাতন ও হয়রানি, হিযবুত তাহ্রীর নিষিদ্ধ ঘোষণা, রাজনৈতিক সহিংসতার ভয়াবহতা, সভা-সমাবেশে পুলিশি বাধা, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সংগ্রামে নিয়োজিত নেতাদের আটক করে ভারতের হাতে তুলে দেয়া, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতন, নারী নির্যাতন, যৌতুকের সহিংসতা ও ইভটিজিং, তৈরি পোশাক খাতে অস্থিরতা, গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ড ও ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের লাশ গায়েব, অধিকারের নির্যাতন প্রতিরোধবিষয়ক কার্যক্রমের মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন নাকচ—মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব বিষয়ে কঠোর সমালোচনা করেছে অধিকার।
চলতি বছর বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, বিএনপি নেতা লুত্ফুজ্জামান বাবর, এহসানুল হক মিলনসহ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার এবং নির্যাতন চালানো হয়েছে। রিমান্ডে নিয়ে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে চালান করে হয়রানি ও নির্যাতন চালানো হয়েছে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অ্যারেস্ট দেখিয়ে ও মামলা দিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে।
গত ১৬ ডিসেম্বর বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার করেই তাকে বেদম মারধর করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে কোনো ধরনের নির্যাতন করা হয়নি। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, তিনি নির্যাতিত হলে তার পোশাকে রক্তের দাগ থাকত। তার জামায় রক্তের দাগ নেই। তিনি আরও বলেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রক্ত আর সাদা নয় যে দাগ থাকবে না। নিম্ন আদালতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী রক্তমাখা টিস্যু উপস্থাপন করেন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সরকারপক্ষের পিপি বলেন, লাল রং মেখে ওই টিস্যু আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। এর আগে চট্টগ্রামে লুত্ফুজ্জামান বাবরের নাক দিয়ে রক্ত পড়া অবস্থায় এবং তার পাঞ্জাবি রক্তাক্ত অবস্থায় রিমান্ডে নেয়ার ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছিলেন ৫ জন। ফেব্রুয়ারিতে র্যাব-পুলিশের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ১২ জন। জেলহাজতে মারা যান ৬ জন। মার্চ মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ৭ জন। এপ্রিলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ক্রসফায়ারে ৯ নিহত হয়েছেন। এপ্রিলে ৫ জন জেল হেফাজতে অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে জানা গেছে। গত ২৭ এপ্রিল মিজানুর রহমান সুমন নামের এক ব্যবসায়ীকে সাদা পোশাকধারী র্যাব সদস্যরা গাইবান্ধার মহিমগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করে ঢাকায় নিয়ে আসে। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন।
মে মাসে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ১৭ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৪ জনের নির্যাতনের ফলে মৃত্যু হয়েছে। গত ১১ মে চট্টগ্রামের রেয়াজউদ্দিন বাজারের আঞ্জুমান আবাসিক হোটেলের নৈশপ্রহরী মানিক মারা যান। ১৩ মে নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানা হেফাজতে রবিউল ইসলাম খোকন নামে এক ব্যক্তি মারা গেছেন। ঢাকায় র্যাব-১ হেফাজতে আবুল কালাম আজাদ নামে এক ব্যবসায়ী মারা গেছেন।
জুনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ১১ জন। গত ৩০ জুন রাতে মিজানুর রহমান নামে এক ব্যবসায়ী গুলশান থানা হেফাজতে মারা গেছেন। মিজানের স্ত্রী তাসলিমা বেগম অভিযোগ করেন, তার স্বামীকে বারিধারার নয়ানগর থেকে গত ২৯ জুন পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এরপর তার কাছে পুলিশ ১ লাখ টাকা চায়। টাকা না পেয়ে পুলিশ তার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করে। যে রাতে তার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করা হয় সে রাতেই গুলশান থানা হাজতে তিনি তার স্বামীর জন্য খাবার দিয়ে আসেন। ৩০ জুন রাতে পুলিশ মিজানকে হাত-পা বেঁধে হাজত থেকে বাইরে নিয়ে যায় এবং মাটিতে শুইয়ে পায়ে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে। এ ঘটনাটির তদন্ত করে অধিকার। তাদের তদন্তে প্রমাণিত হয় মিজানকে গুলি করে হত্যা করার। মিজানকে হত্যার পর তার পরিবারের অসহায় অবস্থা। তার স্ত্রী ও সন্তানদের অর্ধাহার-অনাহারে দিন কাটে। এরপরও তাদের ওপর নানা ধরনের হুমকি দিয়ে ওই ঘটনা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য বলা হয়।
২৯ জুন রমনা থানা হেফাজতে মারা যান বাবুল গাজী নামে এক ব্যক্তি। গত ২৫ জুন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয়ে অপহরণ করা হয় জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগরীর ৫৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলমকে। আজও চৌধুরী আলমের প্রতীক্ষায় দিন কাটাচ্ছে তার পরিবার। স্বামীর শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন চৌধুরী আলমের স্ত্রী হাসিনা চৌধুরী (৫৫)। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে বাবার পথ চেয়ে দিন কাটায়। হাসিনা চৌধুরী ১৪ বছর ধরে ডায়াবেটিসের রোগী। স্বামীর শোকে তিনিও এখন মৃতপ্রায়। তিনি কোথায় কী অবস্থায় আছেন কোনো খবরই পাচ্ছেন না। অসুস্থ অবস্থায় স্বামীকে খুঁজতে গিয়ে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। হাসিনা চৌধুরী বলেন, একজন অসুস্থ মানুষকে কারা আটক করে নিয়ে কী অবস্থায়, কোথায় রাখা হয়েছে কিছুই জানি না। মনে হয় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর স্বামীর মুখ দেখতে পারব না। চৌধুরী আলমের ছোট ভাই খোরশেদ আলম মিন্টু বলেন, আমার ভাই যদি কোনো অপরাধ করে থাকে তার আইন অনুযায়ী বিচার হোক। তিনি নিখোঁজ হওয়ার ছয় মাস হয়েছে; কিন্তু তার নিখোঁজ হওয়া নিয়ে কেউ মুখ খুলছেন না।
জুলাই মাসে ১০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এদের মধ্যে ৬ জনই ক্রসফায়ারে মারা গেছে। ৩ জন মারা গেছে পুলিশের নির্যাতনে। গত ৩ জুলাই মজিবর নামে এক ব্যক্তিকে মিরপুরের দারুস সালাম থানার সাদা পোশাকধারী পুলিশ ধরে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ৪ জুলাই তার লাশ তুরাগ নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। মজিবরকে যখন পুলিশ ধরে নিয়ে যায় তখন তার সঙ্গে সাত বছরের ছেলে ইকবাল ছিল। পুলিশ তার ছেলের সামনেই তাকে মারধর করে এবং পানিতে ডুবায়।
আগস্ট মাসে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ৮ জন নিহত হয়েছেন। অভিযোগ পাওয়া গেছে, এদের মধ্যে র্যাবের হাতে ৬ জন এবং পুলিশ হাতে ১ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে দু’জনের নির্যাতনের ফলে মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে রেহাই পায়নি পুলিশ সদস্যরাও। গত ১৪ আগস্ট যশোর জেলার শার্শা উপজেলায় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা হামিদ নামে এক বিএনপি কর্মীকে পায়ের রগ কেটে খুন করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরই জের ধরে ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ এমপি শেখ আফিল উদ্দিন শার্শা থানার ওসি এনামুল হককে তার অফিসে ডেকে পাঠান। এনামুল হক এমপির অফিসে গেলে তাকে মারধর করেন আপিল উদ্দিন এমপি ও তার ক্যাডাররা।
সেপ্টেম্বর মাসে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লা নূর বাবুকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা, সিরাজগঞ্জে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সমাবেশে ৭ জনকে হত্যা করা হয়।
অক্টোবর মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ফলে নিহতদের মধ্যে ১১ জনই ক্রসফায়ারে মারা গেছে। গত ২৩ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জে ‘আর্মি হাউজিং স্কিম’ নামে সেনাবাহিনীর আবাসন প্রকল্পের জন্য জমি গ্রহণের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে স্থানীয় জনগণ। এ সময় উত্তেজিত জনতার ওপর গুলি চালানো হয়। এরপর জনতা হামলা চালিয়ে সেনাবাহিনীর একটি জিপ, দুটি গাড়িসহ সেনা টিনশেড ব্যারাক পুড়িয়ে দেয়। এ সময় সেনাসদস্য, র্যাব ও পুলিশের গুলিতে ১৪ জন গুলিবিদ্ধ হয়। এরপর রূপগঞ্জ থেকে ৪টি সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়। ওইসব ক্যাম্পে থাকা সেনা সদস্যদের হেলিকপ্টারে ঢাকায় নেয়া হয়। গত ২৪ অক্টোবর গুলিবিদ্ধ মোস্তফা জামাল হায়দার হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান।
তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ১৪ জন নিহত হয়েছেন। পুলিশি নির্যাতনে মারা যান ৪ জন ও জেল হেফাজতে মারা গেছেন আরও ৪ জন। গত ১৪ নভেম্বর নরসিংদী সদর মডেল থানা পুলিশের হেফাজতে শরীফ মিয়া নামে এক ব্যক্তি মারা গেছেন। শরীফ মিয়ার মা বলেন, তার ছেলে ছিল সম্পূর্ণ নির্দোষ। সে ছিল তাঁত শ্রমিক। থানা হেফাজতে নির্যাতন করে শরীফকে হত্যা করা হয়েছে। ২২ নভেম্বর যশোরের কোতোয়ালি থানা হেফাজতে ইমরান হোসেন বাপ্পী নামে এক যুবক মারা গেছেন।
ডিসেম্বর মাসজুড়েও অব্যাহত ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘন। এই মাসে একই দিনে ডাবল ক্রসফায়ার, ত্রিপল ক্রসফায়ারের খবর প্রকাশ হয়েছে পত্রিকায়। এই মাসে কমপক্ষে ১২ জন ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন। অভিযোগ ওঠে অগ্নিকাণ্ড ও ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের লাশ গায়েবের। গত ৩ ডিসেম্বর ঢাকা, বরিশাল ও মেহেরপুরে ক্রসফায়ারে মারা যান ৩ জন। ৪ ডিসেম্বর বরিশালের বরগুনায় ছাত্রীর পা কেটে নেয় বখাটেরা। ৯ ডিসেম্বর নরসিংদীতে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত অনেকের লাশ গায়েবের অভিযোগ ওঠে। একইভাবে ১৪ ডিসেম্বর সাভারের হামীম গ্রুপের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত অনেক শ্রমিকের লাশ গায়েব করার অভিযোগও করেন তাদের স্বজনরা। এর আগে ১৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম ইপিজেডে বেতনভাতার দাবিতে বিক্ষোভরত গার্মেন্ট শ্রমিকদের ওপর পুলিশের গুলিতে ৩ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। ১৬ ডিসেম্বর গ্রেফতার করা হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে। ২০ ডিসেম্বর ঢাকা ও টাঙ্গাইলে ক্রসফায়ারে নিহত হন দু’জন। ২১ ডিসেম্বর ক্রসফায়ারে মারা যান আরও দু’জন