Wednesday 29 December 2010

রিমান্ড শেষে আদালতে না তুলেই সা. কাদেরকে জেলে প্রেরণ : শুনানিতে হট্টগোল, বিচার দেখলেন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা



স্টাফ রিপোর্টার
টানা ৫ দিন রিমান্ড শেষে বিএনপি নেতা ও বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গতকাল কারাগারে পাঠানো হয়েছে। শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য তাকে আদালতে হাজির করা নিয়ে উভয় পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে তুমুল হট্টগোল, বাকবিতণ্ডা ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। শেষ পর্যন্ত তাকে আদালতে হাজির না করেই জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয়া হয়। একই সঙ্গে আদালত তাকে উন্নত চিকিত্সা এবং কারাগারে প্রথম শ্রেণীর কয়েদির মর্যাদা দেয়ার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেন। আদালতে উপস্থিত থেকে আইনজীবীদের শুনানি ও বিচার কাজ পর্যবেক্ষণ করেন মার্কিন দূতাবাসসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তারা। তবে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে আইনজীবীসহ পর্যবেক্ষকদের কাউকেই দেখা করতে দেয়া হয়নি। শুনানিকালে তার মুক্তির দাবিতে আদালত চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল করার সময় ছাত্রদল ও যুবদল নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশ এবং ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। মিছিল থেকে পুলিশ ছাত্রদলের ১০ নেতাকে আটক করে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে গেছে।
রিমান্ডে নিয়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ওপর বর্বর নির্যাতন ও অমানবিক আচরণ করা হয়েছে বলে তার আইনজীবীরা সাংবাদিক ও বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে অভিযোগ করেছেন। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমদ তালুকদার বলেন, নির্যাতন করে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জীবন বিপন্ন করে দেয়া হয়েছে। এ কারণেই তাকে কোর্ট হাজত থেকে আদালতে তুলতে দেয়নি সরকার পক্ষ। কোর্ট হাজতে রেখেই পরে তাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গত ১৬ ডিসেম্বর ভোররাতে র্যাব ও পুলিশ আটক করার পর ওইদিনই তাকে মগবাজারে একটি গাড়িতে আগুন দেয়ার কথিত অভিযোগে দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ড নেয় ডিবি পুলিশ।
আদালতে তুমুল হট্টগোল : সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গতকাল একটি প্রিজন ভ্যানে করে ডিবি কার্যালয় থেকে কড়া পুলিশি প্রহরায় কোর্ট হাজতে নেয়া হয় বেলা আড়াইটার দিকে। বেলা পৌনে তিনটার দিকে মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তফা শাহরিয়ার খানের আদালতে শুনানি শুরু হলে অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমদ তালুকদার সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে কোর্ট হাজত থেকে আদালতে উঠানোর জন্য আবেদন করে বলেন, ৫ দিন রিমান্ডে রেখে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে। গ্রেফতারের দিন থেকে তার সঙ্গে পরিবারের সদস্য তো দূরের কথা, কোনো আইনজীবীকেও দেখা করতে দেয়া হয়নি। ডিবি কার্যালয় থেকে তাকে কোর্ট হাজতে এনে রাখা হয়েছে। তাকে আদালতে তোলা হলে তার ওপর কি নির্মম নির্যাতন করা হয়েছে তা আদালত পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। রিমান্ড ফেরত আসামিদের আদালতে উপস্থাপন করে বিচারক তার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের বিষয়ে উচ্চ আদালতেরও নির্দেশনা রয়েছে। তার ওপর নির্যাতনে পরিবারের সদস্যরা উদ্বিগ্ন। আমরাও তার জীবন নিয়ে শঙ্কিত। আমরা চাই আইনের বিধান মেনেই তাকে আদালতে তোলা হোক। অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমদের এ আবেদনের বিরোধিতা করে সরকার পক্ষ ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা একযোগে চিত্কার করে বলতে থাকেন, আসামিকে আদালতে না তুলেও শুনানি করা যায়। আসামির ব্যাপারে নতুন করে রিমান্ড চাওয়া হয়নি। এমনকি তাকে নতুন কোনো মামলায় শ্যোন অ্যারেস্টও করা হয়নি। কাজেই তাকে আদালতে তুলে সময় নষ্ট করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। সরকার পক্ষের আইনজীবীদের এ বক্তব্যে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবীরা একযোগে প্রতিবাদ করতে থাকেন। অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমদ তালুকদার বলেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। গত ৩২ বছর ধরে তিনি জাতীয় সংসদের সদস্য। তার মতো একজন জাতীয় ব্যক্তিত্বকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। অথচ এখন সরকার পক্ষ তাকে আদালতে তুলতে বাধা দিচ্ছে। এটা আইনের লঙ্ঘন ও ন্যায়বিচার পরিপন্থী। এ সময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম বক্তব্য দিতে চাইলে সরকার পক্ষের ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা একযোগে চিত্কার ও চেঁচামেচি শুরু করে দেন। তারা ফখরুল ইসলামকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি কথা বলতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে আসতে হবে। আপনি মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতীয় বাহিনী নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়েছেন। আপনি তো বাংলাদেশের নাগরিকই নন। এ নিয়ে দ্বিতীয় দফা হইচই শুরু হলে বিচারক এজলাস ত্যাগ করে খাস কামরায় চলে যান। উভয় পক্ষের সিনিয়র আইনজীবীরা পরামর্শ করে পেশকারের মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেটকে আবার এজলাসে আসার অনুরোধ জানান। হট্টগোল থামলে ম্যাজিস্ট্রেট ১০ মিনিট পর আবার এজলাসে এসে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে আদালতে না তুলেই শুনানি করার পরামর্শ দেন আইনজীবীদের।
জামিনের শুনানি : জামিন আবেদন পেশ করে অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমদ তালুকদার আদালতে বলেন, মগবাজারে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগে দায়ের করা মামলাটি রাজনৈতিক। এ মামলার ভবিষ্যত্ও রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল। ঘটনার তিনদিন আগে থেকেই সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ঢাকায় ছিলেন না। তিনি ছিলেন চট্টগ্রামে। সেখান থেকে একটা মানুষের পক্ষে ঢাকার মগবাজারে নিজে সশরীরে হাজির হয়ে গাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনা বিশ্বের কোনো পাগলও বিশ্বাস করবে না। অথচ সরকারের সংশ্লিষ্টরা এটা বিশ্বাসযোগ্য করার চেষ্টা করছেন। এ মামলায় আমরা তার জামিন মঞ্জুরের আবেদন করছি। এ পর্যায়ে আদালত আর কোনো আবেদন আছে কিনা জানতে চান। জবাবে মাসুদ আহমদ তালুকদার বলেন, যদি জামিন নামঞ্জুর হয়, তাহলে কারাগারে তাকে ডিভিশন প্রদান ও উন্নত চিকিত্সা সংক্রান্ত আমাদের আরও দুটি আবেদন রয়েছে।
জামিন আবেদনের বিরোধিতা করে পিপি আবদুল্লাহ আবু আদালতে বলেন, এ মামলায় জামিন মঞ্জুরের কোনো সুযোগ নেই। তার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। এ মামলায় তাকে জামিনে মুক্তি দিলে তিনি পালিয়েও যেতে পারেন। কাজেই তাকে জামিন দেয়া যাবে না। জবাবে মাসুদ আহমদ তালুকদার বলেন, আমরা শুনানি করছি গাড়িতে আগুন দেয়ার মামলা নিয়ে। এখানে অন্য কোনো মামলা বা ইস্যু নিয়ে আসা আইনসম্মত নয়। মূলত বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের রাজনৈতিকভাবে হয়রানির জন্য সরকার প্রহসনের মামলা ও ফরমায়েশি বিচারের আয়োজন করেছে। এ মামলা তারই নিকৃষ্ট প্রমাণ। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরীকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে আদালত কারাগারে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে প্রথম শ্রেণীর কয়েদির মর্যাদা দেয়ার নির্দেশ দেন।
কূটনীতিকদের পর্যবেক্ষণ : সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ওপর অমানবিক নির্যাতনের বিষয়টি দেখা এবং তার বিচার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার জন্য ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের দুইজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অপর একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার একজন প্রতিনিধি গতকাল বেলা ১টায় আদালতে যান। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে কোর্ট হাজত থেকে আদালতে না উঠানোর কারণে তার ওপর কি ধরনের নির্যাতন হয়েছে তা দেখতে পারেননি। আদালতে সরকার পক্ষের বিরোধিতা এবং ছাত্রদল ও আইনজীবীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ, গ্রেফতার ও টানাহেঁচড়ার দৃশ্য তারা প্রত্যক্ষ করেন। গত ১৬ ডিসেম্বর সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতারের পর ক্যান্টনমেন্ট ও ডিবি কার্যালয়ে তার ওপর প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়েছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় মার্কিন দূতাবাসসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে দেখা এবং তার বিচার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে আদালতে যান।
১০ নেতাকর্মী গ্রেফতার : সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে আদালতে হাজির করা হবে জেনে দুপুর থেকেই বিএনপি, ছাত্রদল ও যুবদলের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী পুরান ঢাকার কোর্ট এলাকায় সমবেত হন। তারা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মুক্তি দাবি করে স্লোগান দেন। একই সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগেরও বেশ কিছুসংখ্যক নেতাকর্মী জড়ো হয়ে তার শাস্তি দাবিতে মিছিল করে। পুলিশ ছাত্রদল ও যুবদলের মিছিলে লাঠিচার্জ করে আদালত চত্বর থেকে সরিয়ে দিয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের জায়গা করে দেয়। এ নিয়ে ত্রিমুখী সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। পুলিশের সঙ্গে যোগ দিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরাও বিএনপির মিছিলে হামলা করে। এখান থেকে ছাত্রদল ঢাকা মহানগর (দ.) সভাপতি মোহাম্মদ ইসহাক ও কোতোয়ালি থানা সভাপতি মোস্তাক আহমদসহ ১০ জনকে আটক করা হয়। ছাত্রদলের আটককৃত অপর নেতাকর্মীরা হচ্ছেন মানিক হোসেন, মিন্টু, জাহাঙ্গীর হোসেন, শাহ কামাল, মো. জাহাঙ্গীর, জিটু ও ফরিদ। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তাদের কোতোয়ালি থানায় আটক রাখা হয়েছে। কোতোয়ালি থানার ডিউটি অফিসার আমার দেশকে জানান, ওসি সাহেব থানায় এলে আটককৃতদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তাদের কোনো মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট করা হবে, নাকি নতুন মামলা দিয়ে চালান দেয়া হবে তার সিদ্ধান্ত হয়নি।
আদালতে সরকার পক্ষে শুনানি করেন পিপি আবদুল্লাহ আবু, অ্যাডভোকেট আবদুর রহমান হাওলাদার, মুখলেছুর রহমান প্রমুখ। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমদ তালুকদার, মহসিন মিয়া, ওমর ফারুক ফারুকী, মোসলেহউদ্দিন জসিম, খোরশেদ আলম তালুকদার, জয়নাল আবেদীন মেজবাহ প্রমুখ। শুনানির সময় আদালতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েরা উপস্থিত ছিলেন। পরে আদালতের অনুমতি নিয়ে তারা কোর্ট হাজতে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন

No comments:

Post a Comment