Tuesday 31 May 2011

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ : বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সরকার ব্যর্থ : মাহমুদুর রহমানের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছে



বশীর আহমেদ
বর্তমান সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। র্যাব এবং পুলিশ সদস্যরা অযৌক্তিকভাবে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের আটক করছে। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর চালানো হয়েছে নির্মম নির্যাতন। বাংলাদেশে নারীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণসহ নানা ধরনের সহিংসতা চলছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
গতকাল লন্ডনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ‘দি স্টেট অব দি ওয়ার্ল্ডস হিউম্যান রাইটস’ শীর্ষক এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়।
রিপোর্টে এশিয়া প্যাসিফিক চ্যাপ্টারে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে বলা হয়, সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী ২০১০ সালের প্রথম ১০ মাসে র্যাব এবং পুলিশের হাতে ৬০ জনেরও বেশি মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যার উদাহরণ দিয়ে রিপোর্টে বলা হয়, গত জুলাই মাসে কুষ্টিয়া জেলার কোনাবাড়িয়া গ্রামের আবদুল আলীমকে পুলিশ সবার সামনে আটক করে। পরের দিন সকালে তার গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পাওয়া যায়। পরে পুলিশ দাবি করে আবদুল আলীমকে গ্রেফতার করতে গেলে সে প্রতিরোধ করে এবং নিহত হয়। আলীমের পরিবারের পক্ষ থেকে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো সুবিচার পাওয়া যায়নি।
বন্দি নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়, দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গত বছর ২ জুন আটক করা হয় এই অভিযোগ এনে যে, তিনি বৈধ লাইসেন্স ছাড়া পত্রিকা চালাচ্ছেন। আটক অবস্থায় মাহমুদুর রহমানকে পুলিশ নির্মমভাবে প্রহার করেছে। মাহমুদুর রহমান আদালতে তার ওপর চালানো নির্যাতনের বর্ণনা দেন।
রিপোর্টে বলা হয়, আটক অবস্থায় নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনে গত বছর অন্তত ৬ জন মারা গেছে। এসব ঘটনা নিয়ে পুলিশি তদন্ত হলেও এখন পর্যন্ত দায়ীদের কাউকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। আটক অবস্থায় গর্ভবতী গার্মেন্ট শ্রমিকরাও নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতন থেকে রক্ষা পায়নি বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে।
মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের প্রসঙ্গ তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়, র্যাব এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর বেপরোয়া শক্তি প্রয়োগ করছে। তারা বিএনপি নেতা এবং সাবেক মেয়র মির্জা আব্বাসের বাড়িতে হরতালের আগের রাতে হামলা চালায়। ওই হামলায় অন্তত ২০ জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল নারী।
অযৌক্তিকভাবে গ্রেফতার এবং ডিটেনশনের কথা উল্লেখ করে অ্যামনেস্টির রিপোর্টে বলা হয়, র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন রাজনৈতিক ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনকালে দেড় হাজারের বেশি মানুষকে নির্বিচারে আটক করে। ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিল এবং বিভিন্ন সমাবেশ থেকে তাদের আটক করা হয়। এদের অনেকের বিরুদ্ধে আনা হয় ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাঝে ছাত্রশিবিরের অন্তত ৩০০ সদস্যকে আটক করা হয়। জুন মাসে বিএনপির ২০ নেতাসহ আটক করা হয় ২০০ জনকে।
যুদ্ধপরাধের বিচার প্রসঙ্গে রিপোর্টে বলা হয়, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের জন্য বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। সরকার বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মো. কামারুজ্জামান এবং আবদুল কাদের মোল্লাকে গ্রেফতার করে তাদের এখন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত বলে দেখানো হচ্ছে। তবে তাদের গ্রেফতার করা হয় অন্য অভিযোগে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের জন্য যুদ্ধাপরাধ বিচার আইন ১৯৭৩ গত ২০০৯ সালে সংশোধন করা হয়েছে। বিদ্যমান এই আইনে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি রয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র তুলে ধরে রিপোর্টে বল হয়, নারীর প্রতি সহিংসতার ৭ হাজার ২৮৫টি অভিযোগ পুলিশের কাছে এসেছে ২০১০ সালের প্রথম ৬ মাসে। এর মধ্যে ধর্ষণের অভিযোগ ছিল ১ হাজার ৫৮৬টি

সংবাদ সম্মেলনে স্টিফেন জে র্যাপ : যুদ্ধাপরাধের বিচারে সহায়তা পেতে আইন সংশোধন করতে হবে















কূটনৈতিক রিপোর্টার

যুদ্ধাপরাধবিষয়ক মার্কিন অ্যাম্বাসাডর অ্যাট লার্জ স্টিফেন জে র্যাপ বলেন, বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচারে মার্কিন সহায়তা পেতে হলে বিদ্যমান আইন সংশোধন করতে হবে।
তিন দিনের সফর শেষে ঢাকা ছাড়ার আগে গতকাল রাজধানীর আমেরিকান ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই মন্তব্য করেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মার্কিন এই বিশেষ দূত বলেন, গত জানুয়ারিতে ঢাকা সফরের সময়ে বাংলাদেশের যুদ্ধা-পরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে আমি বেশকিছু সুপারিশ সরকারকে দিয়েছিলাম। এবারের সফরে এসে সেসব বিষয়ে আইনমন্ত্রী এবং ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তাদের এ ব্যাপারে আন্তরিক বলেই মনে হয়েছে। তারা আমাকে আশ্বস্ত করেছেন, বিদ্যমান বিধিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে। তিনি বলেন, আমি তাদের জানিয়েছি, এই বিধি সংশোধনের জন্য সংসদের প্রয়োজন নেই। সরকার এবং বিচারকরা রুলস অব বিজনেস পরিবর্তন করে তা করতে পারেন। পরিবর্তিত বিধি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আইসিসি আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা যায়।
যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় মার্কিন সহায়তার বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্টিফেন র্যাপ বলেন, আমাদের সুপারিশ অনুযায়ী আগে বিদ্যমান বিধির সংশোধন করতে হবে। এই সংশোধনের মাধ্যমে বিদ্যমান বিধি যদি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত হয়, তাহলেই কেবল আমি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচারে সহায়তার জন্য কংগ্রেসকে অনুরোধ জানাতে পারব। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ট্রাইব্যুনালের বিচারক, তদন্ত কর্মকর্তা এবং আইনজীবীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করতে পারে।
যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগপত্র দাখিল না করে মাসের পর মাস আটকে রাখা হচ্ছে—এ ব্যাপারে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে র্যাপ বলেন, তাদের জামিনের বিষয়টি ট্রাইব্যুনাল বিবেচনা করতে পারে। তবে জামিন দেয়া-না দেয়ার বিষয়টি তাদের এখতিয়ার। বিচারকরা এ ব্যাপারে মাসে মাসে পর্যালোচনা করতে পারেন। সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসামি এবং বাদী উভয়পক্ষের সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। প্রাথমিকভাবে নিরাপত্তার জন্য সাক্ষীদের নাম-ঠিকানা গোপন রাখা যেতে পারে। তবে একটি পর্যায়ে এসে তা অবশ্যই জনসাধারণকে জানাতে হবে। কারণ তা না হলে বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সাংবাদিকদের অন্য এক প্রশ্নের জবাবে মার্কিন দূত বলেন, এই বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসময় লাগতে পারে। তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা, অভিযোগ দায়ের করা, সাক্ষ্য গ্রহণ, আইনজীবীদের যুক্তি-পাল্টা যুক্তি উপস্থাপনসহ রায়ের পর সুপ্রিমকোর্টে আপিল—সব মিলিয়ে এটা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তাই এই বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে যদি কোনো পলিটিক্যাল ক্যালেন্ডার শেষ হয়ে যায় তাহলেও যেন বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে।
সংবাদ সম্মেলনে স্টিফেন জে র্যাপ আরও বলেন, মানুষের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। তাই এই বিচার প্রক্রিয়ায় যাতে কারও নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার লঙ্ঘন না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।