Tuesday 26 April 2011

সেমিনারে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক : সর্বোচ্চ আদালতের বিচার প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে











কূটনৈতিক রিপোর্টার
বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, বর্তমানে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকাজে অনেক ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। বিচারকরা যে রায় দিচ্ছেন, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে রায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে হিউম্যান রাইটস অ্যাডভোকেসি কাউন্সিল আয়োজিত ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এই মন্তব্য করেন। দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল মান্নান, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব শওকত মাহমুদ, হিউম্যান রাইটস অ্যাডভোকেসি কাউন্সিলের সভাপতি ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম, সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
সেমিনারে বাংলাদেশে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক তার বক্তৃতায় বলেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকরা তাদের ইচ্ছেমত সুয়োমোটো রুল দিচ্ছেন তথাকথিত জনস্বার্থের কথা বলে। তাদের রায়গুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সেখানে অনেক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে।
আদালত অবমাননার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, মাহমুদুর রহমানকে ৬ মাসের জেল এবং ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল অথচ রায়ে বিচারকরা বলতে পারেননি কীভাবে আদালত অবমাননা হয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, মাহমুদুর রহমানের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বা দেহভঙ্গি ভালো ছিল না। আবার একই ধরনের অন্য মামলায় একশ’ টাকা জরিমানা অনাদায়ে একদিনের জেল। এই হলো আদালতের অবস্থা। তিনি আরও বলেন, এখন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিচারকরা খুব বলছেন। আবার সামরিক শাসন যদি এসে যায়, প্রথমেই এই বিচারকরা বঙ্গভবনে হাজির হবেন শপথ পড়ানোর জন্য। তিনি দুই নেত্রীসহ সবার প্রতি সহনশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, একে অন্যকে কথার মাধ্যমে অপমান করাও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। সবার উচিত সহনশীল হওয়া। কখন কাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে তা কেউ জানেন না।
নতুন প্রজন্মের মধ্যে মানবাধিকার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, এই সমাজে এখন কেউ নিরাপদ নয়। সরকার সংবিধান তছনছ করে মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করেছে। দলীয় লোক এবং পুলিশ দিয়ে চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এখন সময় এসেছে প্রতিরোধের। তিনি বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা না হলে মানবাধিকার রক্ষা হবে না। বাংলাদেশে সরকার যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, তা কোনো সভ্য সমাজে চলতে পারে না।
সভাপতির বক্তৃতায় মাহমুদুর রহমান বলেন, বর্তমান সরকার মানবাধিকারে বিশ্বাস করে না। তারা মানবাধিকারে বিশ্বাস করে না বলেই নিজেরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে এবং পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র যখন এদেশের নিরীহ মানুষদের গুলি করে হত্যা করছে, তখন তার প্রতিবাদ করে না। তিনি বলেন, ১/১১-এর সরকারের সময় যাদের আত্মীয়-পরিজনদের ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের চেম্বারে পড়ে পড়ে কাঁদতে দেখেছি, আজ তারাই মানবাধিকার লঙ্ঘনে লিপ্ত হয়েছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক। আজ যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছেন, তাদের মানবাধিকার রক্ষার জন্য সেই কঠিন দিনগুলোতে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক আইনের মাধ্যমে আর আমি কলমের মাধ্যমে লড়াই করেছি। তিনি বিএনপির উদ্দেশে বলেন, আপনারা যদি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যান, তখন মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টিকে একটি আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবেন—এটাই আমাদের প্রত্যাশা। ক্ষমতায় এসে প্রতিশোধ গ্রহণ করব—এই চিন্তা যেন না থাকে। তিনি নিজের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, আমি প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করি না। আগামী দিনগুলোতে যদি মানবাধিকার লঙ্ঘনমুক্ত একটি দেশ আমরা পাই, তা হলে আমার ওপর যে নির্যাতন হয়েছে সেই নির্যাতনের কষ্ট ভুলে যাব। মানবাধিকারের প্রশ্নে আমরা সবাই যদি দল-মত নির্বিশেষে একত্রে দাঁড়াতে পারি, তাহলে সেটাই হবে সবচেয়ে বড় অর্জন।
নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে শওকত মাহমুদ তার বক্তৃতায় বলেন, সরকার যখন উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে, তখন তার নিরাপত্তা বাহিনীও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে। বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সরকার যেভাবে সমর্থন জোগাচ্ছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। হুমকির মুখে পড়েছে আমাদের জাতিরাষ্ট্রের অস্তিত্ব। তিনি বলেন, দেশে এখন একটি আতঙ্কজনক পরিস্থিতি চলছে। আদালতের দায়িত্ব তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা। সেখানে আদালত যদি তার ক্ষমতা ব্যবহার করে সাংবাদিকদের শাস্তি দিতে তত্পর হন, সেক্ষেত্রে আমাদের আতঙ্কিত হতে হয়

ক্রসফায়ার থেকে বেঁচে আসা ২ যুবকের লোমহর্ষক কাহিনী : র্যাব বিলুপ্তির দাবি এএইচআরসির












বশীর আহমেদ

নিরপরাধ ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে নিষ্ঠুর এবং বর্বর নির্যাতন চালাচ্ছে র্যাব। র্যাবের নির্যাতনের এই ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি)। গত ২০ এপ্রিল প্রকাশিত কমিশনের এক রিপোর্টে র্যাব সদস্যদের নির্যাতনের দুটি কেস স্টাডি তুলে ধরা হয়েছে। কেস স্টাডিতে রাজীব এবং সজীব নামে পুরান ঢাকার দুই যুবকের ওপর চালানো নির্মম নির্যাতন এবং ক্রসফায়ার থেকে তাদের বেঁচে যাওয়ার লোমহর্ষক কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। এ সম্পর্কে র্যাবের পরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া) কমান্ডার সোয়াহেলের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের রিপোর্টটি আমাদের হাতে আসেনি। আমরা এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করব না।
রিপোর্টটিতে বলা হয়, নাহিদুল হক সজীব, বয়স ২৫। লালবাগ থানার অধীন চাঁনখারপুল এলাকায় তার ঘর। সে পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। গত ৫ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে কিছু কেনাকাটার জন্য ঘর থেকে বের হয় সজীব। পাশেই তার ব্যবসা অফিস। অফিসের কাছাকাছি এলেই একদল র্যাব সদস্য সজীবকে থামায়। র্যাব সদস্যরা সজীবের কাছে তার নাম, সে কি করে এগুলো জানতে চায়। সজীব তার নাম এবং ব্যবসার কথা বলার পর এক র্যাব সদস্য সজীবকে বলে ‘তুই একজন ছিনতাইকারী।’ একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে র্যাব সদস্যরা তার চোখ বেঁধে ফেলে গাড়িতে তোলে। চোখ বাঁধার পর তার মুখের ওপর আরও একটি মাস্ক পরিয়ে দেয়া হয়। সজীবকে নিয়ে যাওয়া হয় লালবাগ কেল্লার পাশে অবস্থিত র্যাব-১০-এর ক্যাম্পে। মুখোশ পরিয়ে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে ক্যাম্পের দোতলার একটি সেলে সজীবকে রাখা হয়। গভীর রাতে জিজ্ঞাসাবাদের নামে শুরু হয় তার ওপর নির্যাতন। সেল থেকে কয়েক গজ দূরে পাশের আরেকটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একজন র্যাব কর্মকর্তা তার এবং তার বাবার নাম জানতে চান। সজীব উত্তর দেয়ার পর ওই কর্মকর্তা বলেন, আমি তোকেই খুঁজছি। এ কথা বলেই ওই কর্মকর্তা একটি লাঠি দিয়ে সজীবকে পায়ের তলায়, পিঠে ও কাঁধে বেধড়ক পেটাতে থাকেন। এক পর্যায়ে সজীব অজ্ঞান হয়ে পড়ে। পরে র্যাবেরই একজন ডাক্তার এসে তাকে চিকিত্সা দেন। সজীবের জ্ঞান ফেরার পর র্যাব সদস্যরা তাকে এক প্যাক জুস খেতে দেয়। রাতে র্যাব সদস্যরা সজীবের পায়ের আঙ্গুলের সঙ্গে হ্যাসকে ট্যাগ লাগিয়ে বারবার ইলেকট্রিক শক দেয়। তবে তাকে রাতে আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে দেয়া হয়।
৬ এপ্রিল বেলা আড়াইটায় সজীবকে জানানো হয় র্যাবের একজন বড় কর্মকর্তা এসেছেন। সজীবকে ওই কর্মকর্তার সামনে হাজির করা হয়। ওই কর্মকর্তা তার অধস্তন কর্মকর্তাদের কাছে সজীবের গ্রেফতারের ব্যাপারে জানতে চান। জুনিয়র র্যাব কর্মকর্তারা জানান, সন্দেহ করে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তথ্য বের করার চেষ্টা হচ্ছে। এ সময় ওই কর্মকর্তা বলেন, ঠিক আছে তথ্য বের করে রিপোর্ট তৈরি কর। প্রয়োজন হলে আরও পেটাবে।
এরপর সজীবকে অন্য একটি রুমে নেয়া হয়, সেখানে একজন ডাক্তার তাকে আবার পরীক্ষা করেন।
৭ এপ্রিল রাত ৩টায় র্যাব সদস্যরা সজীবকে অন্য একটি রুমে নিয়ে যায়। সেখানে তারা দীর্ঘ সময় ধরে নানাভাবে সজীবের ওপর নির্যাতন চালায়। তার আঙ্গুলে সূচ ঢোকানো হয়। ধারালো ধাতব ব্লেড দিয়ে সজীবের নখ কেটে ফেলা হয়। এরপর ওই নখের ওপর এক ধরনের স্প্রে করা হয়, যাতে আঘাতের চিহ্ন বোঝা না যায়। কয়েক দিন পরে সজীবের পায়ের তলায় অস্ত্রের বাঁট দিয়ে নির্মমভাবে পেটানো হয়। এখানেই নির্যাতনের শেষ নয়, র্যাব সদস্যরা সজীবের কানের মধ্যে শক্ত কাঠি ঢুকিয়ে দেয়। এ সময় সজীবের কান দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। এই নির্যাতনের মধ্যে সজীব জানতে চায় কি তার অপরাধ। তার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে র্যাব সদস্যরা আরও নির্যাতন চালায়।
৮ এপ্রিল রাত আড়াইটায় নতুন ৩ র্যাব সদস্য সজীবকে যেখানে আটক রাখা হয়েছে সেখানে আসে। তারা এসেই সজীবকে উপর্যুপরি লাথি মারতে থাকে। পরে মেঝেতে ফেলে বুট দিয়ে নির্মমভাবে পাড়াতে থাকে। সজীব অজ্ঞান হওয়ার আগ পর্যন্ত এই নির্যাতন চলতে থাকে।
৮ এপ্রিল রাতে র্যাব সদস্যরা সজীবের কাছে এসে বলে অজু করে আয়। পরে তাকে সূরা ইয়াসিন এবং সূরা আর-রাহমানের কয়েকটা আয়াত দিয়ে তা পাঠ করতে বলে। সজীব তখন বারবার ওই আয়াতগুলো পড়তে থাকে। সজীবকে আটকের একদিন পর অর্থাত্ ৬ এপ্রিল হোসনি দালান এলাকা থেকে র্যাব সদস্যরা আটক করে কাওসার হোসেন রাজীবকে। রাজীবের বয়স ২৪। প্লাস্টিকের বোতলের ব্যবসা তার। রাজীব ও সজীব সম্পর্কে কাজিন।
তখন রাত আনুমানিক ৮টা। রাজীব তার বাবা আওলাদ হোসেনের সঙ্গে মসজিদে নামাজ পড়তে যাচ্ছিল। পথে সাদা পোশাকে ৮ জনের র্যাবের একটি দল রাজীবকে থামায়। র্যাব সদস্যরা রাজীবকে বলে তাকে তাদের সঙ্গে যেতে হবে। রাজীব এ সময় জানতে চায় তার অপরাধ কী। তখন র্যাব সদস্যরা বলেন একদম চুপ।
রাজীবের বাবা আওলাদ হোসেন এবং ছোট ভাই রনি এ সময় এগিয়ে এসে জানতে চায় কেন রাজীবকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ সময় উত্তেজিত র্যাব সদস্যরা অস্ত্র বের করে বলে কথা বললে গুলি করে মেরে ফেলব। এরপর র্যাব সদস্যরা রাজীবের চোখ এবং মুখ কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে একটি মাইক্রোবাসে করে র্যাব-১০-এর লালবাগ কেল্লার পাশে অবস্থিত ক্যাম্পে নিয়ে যায়। চোখ-মুখ বাঁধা অবস্থায় রাজীবকে প্রায় ১ ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়। এরপর রাজীবকে র্যাবের এক সিনিয়র কর্মকর্তার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। একটি চেয়ারে তাকে চোখ-মুখ বাঁধা অবস্থায় বসানো হয়। এ সময় তার পেছনে বাঁধা হয়। পা দুটি রাখা হয় অন্য একটি চেয়ারের ওপর। হকিস্টিক দিয়ে র্যাব সদস্যরা তার পায়ের তলায় নির্মমভাবে পেটাতে শুরু করে। এরপর আঙুলে লোহার ক্লিপ লাগিয়ে বারবার ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়। প্রায় ১ ঘণ্টা চলে এই নির্যাতন। নির্যাতনের পর তাকে রুমে নিয়ে আসা হয়। তাকে রাতের বেঁচে যাওয়া কিছু খাবার খেতে দেয়া হয়, যা খাওয়ার উপযুক্ত ছিল না। আধ ঘণ্টা পর রাজীবকে আবার অন্য একটি রুমে নেয়া হয়। এ সময় নির্যাতন আর আঘাতের কারণে রাজীব কাঁপছিল। সে হাঁটতে পারছিল না। তখন র্যাব সদস্যরা তাকে হাঁটতে বলে। রাজীব জানায়, তার পায়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। নির্যাতনকারী র্যাব সদস্যরা এখন যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে দেব এই কথা বলে আবার পেটাতে শুরু করে। রাজীবের আঙুল এবং নখের মধ্যে সূই ঢুকিয়ে দেয়। রুমের মেঝেতে পড়ে থাকে রাজীব। নিষ্ঠুর র্যাব সদস্যরা এ সময় রাজীবকে আবার ওঠে দাঁড়াতে বলে। রাজীব জানায়, তার দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। এরপর রাজীবের শরীরের কয়েকটি ধাতব পাত জড়িয়ে ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়। ইলেকট্রিক শকে রাজীব দূরে ছিটকে পড়ে। র্যাব সদস্যরা তখন বলে, তুই নাকি দাঁড়াতে পারবি না, এখন দেখলি তো তুই লাফাতেও পারিস।
এভাবে নির্যাতন চালিয়ে র্যাব-১০-এর সদস্যরা রাজীবকে তাদের নির্দেশমত স্বীকারোক্তি দিতে বলে। আর স্বীকারোক্তি না দিলে তাকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। ৭ এপ্রিল রাজীবকে নিয়ে র্যাব সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায় এবং ক্রসফায়ারে মারার ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করে। র্যাব সদস্যরা বারবার বলে তুই একজন ছিনতাইকারী।
৮ এপ্রিল মধ্যরাতে র্যাব সদস্যরা রাজীব এবং সজীবকে চোখ-মুখ বেঁধে একটি গাড়িতে করে আজিমপুর এলাকার দিকে যায়। গাড়ির মধ্যে যখন তাদের চোখ-মুখ খুলে দেয়া হয়, তখন তারা একে অন্যকে চিনতে পারে এবং একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। এ সময় তাদের ওপর আবার নির্যাতন চালানো হয়। সজীব এবং রাজীবকে নিয়ে র্যাব সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। এক পর্যায়ে তাদের ক্রসফায়ারে মারার জন্য বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সোয়ারীঘাট এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় র্যাবের সঙ্গে পুলিশ এবং অন্যান্য এজেন্সির সদস্যরাও ছিল। র্যাব কর্মকর্তারা এ সময় রাজীব এবং সজীবকে দৌড়াতে বলে। কিন্তু তারা দৌড়াতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা জানে দৌড়ালে তাদের গুলি করা হবে। রাজীব এবং সজীব এক র্যাব কর্মকর্তার পা জড়িয়ে ধরে আকুতি জানায়, আমাদের মারবেন না। আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে চলুন। এ সময় আজিমপুর স্টাফ কোয়ার্টার থেকে দু’জন গার্ডকে নিয়ে আসা হয়েছিল, যারা র্যাবের নির্দেশে রাজীব এবং সজীবকে ছিনতাইকারী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়ে একটি কাগজে সই করে। এরই মধ্যে সকাল হয়ে আসে। র্যাব সদস্যরা ওই রাতে রাজীব এবং সজীবকে না মেরে ফেরত নিয়ে যায়। র্যাবের এক কর্মকর্তা তাদের বলেন, তোদের মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত ছিল। হয়তো জীবনে কোনো ভালো কাজ করেছিলি তাই বেঁচে গেলি। নিয়মিত নামাজ পড়বি।
৯ এপ্রিল সকালবেলা র্যাব-১০-এর ক্যাম্পে সজীব এবং রাজীবকে নিয়ে যাওয়ার পর এক পর্যায়ে পায়ে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত রাজীবকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নেয়া হয়। সজীবকে হাজির করা হয় র্যাবের এক সিনিয়র কর্মকর্তার রুমে। ওই কর্মকর্তা উত্তেজিত কণ্ঠে গালাগাল দিয়ে বলেন, মন্ত্রী-এমপি দিয়ে ফোন করিয়ে ক্ষমতা দেখাস। যা বেঁচে গেলি বলে তিনি সজীবকে পেটাতে থাকেন। এক পর্যায়ে বলেন, আমরা আমাদের ক্ষমতা দেখালাম। এরপর ছিনতাই মামলা দিয়ে দু’জনকে চালান করে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন র্যাব কর্মকর্তা। বিকেলের দিকে হাসপাতাল থেকে রাজীবকে ফিরিয়ে আনা হয়। সজীব ও রাজীব দুজনের বুকে নাম লিখে সামনের টেবিলে দুটি ছুরি রেখে ছবি তোলা হয়। এরপর লালবাগ থানায় নিয়ে ছিনতাইকারি বলে দ্রুত বিচার আইনে মামলা রুজু করতে বললে ডিউটি অফিসার প্রথমে অপারগতা জানান। তার যুক্তি, ছিনতাই করেনি- করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, এ কারণে দ্রুত বিচার আইনে মামলা হয় না। ছিনতাই করলে ছিনতাইকৃত মালামালের দরকার। তখন র্যাব কর্মকর্তা সজীব ও রাজীবকে আটকের সময় তাদের কাছে থাকা মোবাইল এবং টাকা ছিনতাইকৃত বলে উল্লেখ করে মামলা দায়ের করতে বলেন। এক পর্যায়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ডিউটি অফিসার কথা বলেন এবং মামলা রুজু করেন। ১০ এপ্রিল সজীব ও রাজীবকে কোর্টে চালান দেয় পুলিশ। কোর্টে তাদের জামিনের আবেদন মঞ্জুর হয়। র্যাব সদস্যরা পুলিশের হাতে তাদের তুলে দেয়ার আগে শাসিয়ে দেয় নির্যাতনের কাহিনী কোথাও প্রকাশ করলে তাদের মেরে ফেলা হবে। কিন্তু জীবনের মায়া উপেক্ষা করেই মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন সজীব ও রাজীব। তারা জানান, মুক্ত হওয়ার পরও তাদের হুমকি দেয়া হচ্ছে টেলিফোনে।
এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের পক্ষ থেকে র্যাবের এই বর্বর অপরাধের তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির পাশাপাশি অবিলম্বে র্যাব বিলুপ্ত করার দাবি জানানো হয়।

মানবাধিকার লংঘনকারী রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ







বশীর আহমেদ
মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্ট প্রকাশের পর এখন বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ চিত্র নিয়ে সর্বত্রই আলোচনা হচ্ছে। মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা, রিমান্ডের নামে নির্যাতন, বিচার বিভাগ দলীয়করণ ও ন্যায়বিচার না পাওয়া, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ, রাজনৈতিক সহিংসতা, সীমান্তে হত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিস্তারিত বিবরণ উদাহরণসহ তুলে ধরা হয়েছে। তবে মার্কিন এই রিপোর্ট সম্পর্কে বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টটি হতাশাজনক। বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্ট বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, বাংলাদেশ এখন মানবাধিকার হত্যাকারী রাষ্ট্র। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, যাদের দায়িত্ব মানবাধিকার রক্ষা করা তারা এখন ইচ্ছেমত মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান মিঞা তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, বাংলাদেশে এখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
উল্লেখ্য, মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে বলা হয় :
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েই চলেছে। আটক অবস্থায় মৃত্যু, নির্যাতন, অযৌক্তিকভাবে গ্রেফতার এবং ডিটেনশনের জন্য এই নিরাপত্তা বাহিনী দায়ী। বিচারবহির্ভূত এসব হত্যা এবং বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত র্যাবের ব্যাপারে সব ধরনের তদন্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। এটা গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্য এ ধরনের অপরাধ করছে এই নিশ্চয়তা নিয়ে যে, তাদের কোনো শাস্তি হবে না। এতে বিচারের আগেই কারাগারে মৃত্যুঝুঁকির পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কর্তৃপক্ষ নাগরিক অধিকারকে উপেক্ষা করেছে। বিচার বিভাগকে অব্যাহতভাবে রাজনীতিকীকরণ করায় বিচারব্যবস্থায় বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে। এর ফলে বিশেষ করে বিরোধী দলের জন্য এখন ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ
সীমিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার গণমাধ্যম এবং জনগণের বাকস্বাধীনতাকে সীমিত করে ফেলেছে। গণমাধ্যমগুলো সেলফ সেন্সরশিপ করতে বাধ্য হচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রতিনিয়ত হয়রানি করছে সাংবাদিকদের। সরকার সভা-সমাবেশের অধিকারকে সীমিত করেছে এবং অব্যাহত রয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা। এটা এখন একটি বড় সমস্যা।
সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি অব্যাহত গতিতে চলছে এবং দুর্নীতির সঙ্গে যারা যুক্ত, তারা শাস্তির বাইরে থেকে যাচ্ছে। নারীর প্রতি বৈষম্য এবং নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা একটি ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে বাংলাদেশে। নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নারীরা। মানব পাচার এখনও বড় সমস্যা।
মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্ট সম্পর্কে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান আমার দেশকে বলেন, যেনতেনভাবে এ রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। এখানে অনেক পুরনো তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে। উদাহরণসহ এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, এখানে নতুন কিছু নেই। বিষয়গুলো আমাদের জানা।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের এসব ঘটনা বন্ধে কমিশন এখন কী পদক্ষেপ নেবে—এ প্রশ্নের জবাবে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধ করতে আমরা যে কৌশল প্রণয়ন করছি সেখানে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া হবে।
বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, কলামিস্ট ও রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর মার্কিন রিপোর্ট ও বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার দেশকে বলেন, মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টে যেসব তথ্য এসেছে, তার সত্যতা আছে। তবে তাদের এই রিপোর্ট নিয়ে আমাদের হৈচৈ করার কিছু নেই। আমরাই ভালো জানি আমাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে। আমরাই এর ভুক্তভোগী। মার্কিন রিপোর্টে যেসব বিষয় এসেছে, সেসব ব্যাপারে আমরা বলে বলে হয়রান হয়ে গেছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন মানবাধিকার রিপোর্ট দিচ্ছে; কিন্তু তাদের সমর্থন নিয়েই তো সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। তিনি বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সর্বোচ্চ পর্যায়। এর বাইরে আরও ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। কথায় কথায় গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন। আপনার সম্পাদককেও তো বারবার রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করেছে। বিচারকরাও এখন রিমান্ডের অনুমতি দিয়ে দেন। তিনি আরও বলেন, এখন সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হয় না। হরতাল করতে বাধা দেয়া হয়। হরতাল ভালো না খারাপ তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে; কিন্তু হরতাল একটি গণতান্ত্রিক অধিকার।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার দেশকে বলেন, মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে, তার সবই ঠিক। এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তো আমরা এখন পত্রিকার পাতায় প্রতিনিয়ত দেখতে পাই। বিচারবহির্ভূত হত্যা এখন ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। এখানে যার যা খুশি তা-ই করছে। সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে আমার মনে হয় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, যাদের হাতে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব তাদের হাতেই মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। কোনো সভ্য সমাজে এটা চলতে পারে না। মানবাধিকার রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার যদি পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। মানবাধিকার রক্ষায় গণমাধ্যমের ভূমিকা ইতিবাচক। বিরোধী দলের উচিত সংসদে মানবাধিকার ইস্যুতে সোচ্চার হওয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান মিঞা তার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টে তারই প্রতিফলন হয়েছে। আমি মনে করি, মার্কিন এই রিপোর্টটি তথ্যভিত্তিক। বিচারবহির্ভূত হত্যা, ন্যায়বিচার না পাওয়া, দুর্নীতি, রাজনৈতিক সহিংসতাসহ যেসব বিষয় রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে তা সঠিক। তিনি বলেন, এখন সরকার যদি বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানবাধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হয় তাহলেই কেবল পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারে

র্যাব-পুলিশের নতুন কৌশল আটকের পর হাঁটুতে গুলি

নাছির উদ্দন শোয়েব

বুকে গুলিবিদ্ধ হলে নির্ঘাত মৃত্যু, আর হাঁটুতে কিংবা পায়ে গুলি লাগলে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রাণে বেঁচে গেলেও ক্ষতচিহ্ন নিয়ে কাটাতে হয় সারাটি জীবন। অনেকে পঙ্গুও হয়ে যায় চিরতরে। র্যাব ও পুলিশের ক্রসফায়ার নিয়ে আদালত ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার হওয়ায় ভিন্ন কৌশল নিয়েছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। অভিযানের নামে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটকের পর হাঁটুর নিচে অথবা পায়ে গুলি চালিয়ে তাকে অপরাধী বলে প্রচার করা হয়। এই নতুন কৌশলে অপরাধ কমবে বলে র্যাব ও পুলিশের ধারণা। গত দু’বছরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে আহত ও পঙ্গু হয়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। এসব গুলিবিদ্ধের বেশিরভাগই বয়সে কিশোর-তরুণ। তবে আটক বা গুলিবিদ্ধ ভিকটিম পরিবারের দাবি, অভিযানের নামে নিরপরাধ ব্যক্তিকে অপরাধী সন্দেহে তাদের চোখ বেঁধে নির্জন স্থানে নিয়ে গুলি করা হয়েছে। বিভিন্ন সময় আহতদের আত্মীয়-স্বজন ও পরিবারের সদস্যরা এ ধরনের অভিযোগ করেছেন, যার প্রমাণ রয়েছে।
এ ব্যাপারে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার এম সোহায়েল জানান, র্যাব সদস্যদের প্রতি আটক করে কাউকে গুলি করার যে অভিযোগ তা একেবারেই ভিত্তিহীন। অপরাধী গ্রেফতার করতে গিয়ে র্যাব সদস্যদের সঙ্গে দুষ্কৃতকারীদের বিভিন্ন সময়ে গোলাগুলি হয়। এ ধরনের অভিযানের সময় কখনও গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাও ঘটে। র্যাব সদস্যরাও সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়। অভিযানের সময় সন্ত্রাসীরা গুলি চালালে জীবন রক্ষার্থে র্যাব সদস্যদেরও পাল্টা গুলি চালানোর অধিকার রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সন্ত্রাসীদের দমনে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। বেপরোয়া অপরাধীদের গ্রেফতারে অভিযানে নেমে গোলাগুলি এবং গুলিবিদ্ধ হওয়ার অহরহ ঘটনা ঘটছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, সন্দেহ হলেই রাস্তা থেকে কোনো ব্যক্তিকে আটক করে পায়ে গুলি করে আহত করা হয়। সম্প্রতি এ ধরনের অনেক অভিযোগ আসছে। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গুলি করে ছিনতাইকারী ও চাঁদাবাজ বলেও চালিয়ে দেয়া হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে। তবে গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিদের স্বজনরা আটক হওয়া ব্যক্তিকে নিরপরাধ বলে দাবি করেন। অনেক সময় পুলিশের হেফাজতে থাকাকালে ভিকটিম নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করারও সুযোগ পায় না। তবে কয়েকটি ঘটনায় জানা গেছে, পুলিশ যাদের আটক করে ছিনতাইকারী বলে গুলি করেছে এর মধ্যে নিরপরাধ লোকের সংখ্যাই বেশি।
পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গত দু’বছরে র্যাব-পুলিশের গুলিতে প্রায় অর্ধশতাধিক ব্যক্তি পঙ্গু হয়েছে। রাতে টহল দেয়ার সময় সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক করার পর ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছে কিনা, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আবার কখনও কিছুই জানতে না চেয়ে, এমনকি সঠিক তথ্য না নিয়ে সোর্সনির্ভর হয়ে গভীর রাতে চোখ বেঁধে নির্জন স্থানে নিয়ে পায়ে গুলি চালিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়। এরপর হাসপাতালে নিয়ে চিকিত্সাও দেয়া হয় তাদের পাহারায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাহারায় থাকা গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিকে বিভিন্ন কৌশলে অপরাধী বলে প্রচার করা হয়। কখনও শীর্ষ সন্ত্রাসীর সহযোগী, কখনো দাগি অপরাধীর সেকেন্ড ইন কমান্ড, কিলার, চাঁদাবাজ ও ছিনতাইকারী বলে প্রমাণ করার চেষ্টায় থানায় একাধিক কারণ দেখিয়ে মামলা করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিটি ঘটনায়ই র্যাব ও পুলিশের পক্ষ থেকে সেই একই ধরনের গল্প প্রচার করা হয়। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, কোনো পথচারী ছিনতাইকারীর কবলে পড়লে পুলিশের টহল দল তাদের ধাওয়া করলে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় সন্ত্রাসীরা। এসময় পুলিশও পাল্টা গুলি চালালে ছিনতাইকারী আহত বা নিহত হয়। তবে অনুসন্ধান করে আরও জানা গেছে, অধিকাংশ ঘটনায়ই আহত ব্যক্তির পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়। শরীরের অন্য কোথাও গুলি না লাগায় মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায় যে গোলাগুলির ঘটনাটি ছিল রহস্যজনক। একতরফা গুলিতেই আহত হয়েছে ওই ব্যক্তি। অপরদিকে গুলিবিনিময়ের সময় ছিনতাইকারী সন্দেহের ব্যক্তি আটক হলেও তার কাছে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া যায় না। দু-একজনের কাছ থেকে ছোরা উদ্ধার করা হয়েছে বলে পুলিশের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
একটি নির্মম ঘটনা : গত ২৩ মার্চ বিকালে ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামের দিনমজুর তোফাজ্জল হোসেনের ছোট ছেলে লিমন মাঠে গরু আনতে গিয়ে র্যাবের হাতে আটক হয়। কাঁঠালিয়া পিজিএস কারিগরি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী সে। পথে স্থানীয় শহীদ জমাদ্দারের বাড়ির সামনে র্যাব-৮-এর একটি দল তাকে সামনে পেয়ে শার্টের কলার ধরে নাম জিজ্ঞেস করে। লিমন নিজেকে ছাত্র বলে পরিচয় দিলেও র্যাবের এক সদস্য কথাবার্তা ছাড়াই তার বাঁ পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। গুরুতর আহত অবস্থায় বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে পঙ্গু হাসপাতালে আনলে চিকিত্সকরা তার পা কেটে ফেলেন। এই নির্মমতার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হলে লিমনের খবর জানতে গত বুধবার সকালে পঙ্গু হাসপাতালে ছুটে যান গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থার কর্মীরা। কিন্তু হাসপাতালে ঢুকেই তারা হতবাক—যে ওয়ার্ডে লিমন চিকিত্সাধীন সে ওয়ার্ডের দরজা তালাবদ্ধ। দুপুর পর্যন্ত কেউ সেখানে ঢুকতে পারেননি। পরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানও লিমনকে দেখতে হাসপাতালে গেলে লিমনের আত্মীয়-স্বজনরা বিভিন্ন অভিযোগ করেন। বর্তমানে পুলিশ পাহারায় ওই নিরপরাধ কিশোর ছেলেটি হাসপাতালের বেডে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে লিমন তার ওপর র্যাবের নির্মমতার পুরো বিবরণ দিয়েছে। সে চেয়ারম্যানকে বলেছে, স্যার, আমি জীবনে পিস্তল দেখিনি, আর এখন আমি অস্ত্র মামলার আসামি। আমার কপালে কালির দাগ লেগে গেল। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে ওই তরুণ। নিজেকে সামলে রাখতে পারছিলেন না চেয়ারম্যান নিজেও।
এদিকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু সচিবালয়ে নিজ দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, লিমনের ঘটনায় প্রয়োজন হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত কমিটি করা হবে। তবে র্যাবের নিজস্ব বিভাগীয় তদন্ত দল রয়েছে, তারাও তদন্ত করতে পারে। এদিকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন লিমন হোসেনের ঘটনা দ্রুত তদন্তের জন্য অনুরোধ জানিয়ে বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে।
র্যাবের বক্তব্য : লিমনের ব্যাপারে জানতে চাইলে র্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং থেকে এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বলা হয়, পত্রিকায় ঘটনাটি যেভাবে এসেছে প্রকৃত ঘটনা তা নয়। এতে বলা হয়, ২৩ মার্চ দিনের বেলায় র্যাবের দুটি বিশেষ অভিযান দল ১৮টি মামলার আসামি এবং ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ-প্রাপ্ত পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী মোরশেদ জমাদ্দারকে গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে তার গোপন আস্তানায় অভিযান চালায়। ওই আস্তানাটি সন্ত্রাসী মোরশেদের বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ধানক্ষেতের মধ্যে একটি কলাবাগান। খালের পাড় ধরে হেঁটে বাঁশের বেড়া টপকিয়ে মোরশেদের আস্তানায় ঢুকতে হয়। ওই দিন র্যাবের অভিযান দলের অগ্রগামী সাদা পোশাকধারী ২ র্যাব সদস্য মোরশেদের আস্তানায় প্রবেশ করলে লিমনসহ কিছু সন্ত্রাসী এগিয়ে এসে র্যাব সদস্যদের গতিরোধ করে আস্তানায় নেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় র্যাব সদস্যদের সন্দেহ হলে নিজেদের পরিচয় প্রদান করে। এরই মধ্যে কলাবাগানের পেছনে অবস্থানকারী র্যাব পোশাক পরিহিত অভিযান দলের অপর সদস্যরা এগিয়ে আসে। এরই মাঝে ওই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা গ্রেফতার এড়ানোর লক্ষ্যে র্যাব সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তত্ক্ষণাত্ র্যাব সদস্যরাও কিছু দূরে অবস্থান নিয়ে পাল্টা গুলি চালায় এবং আহত অবস্থায় লিমনকে আটক এবং ঘটনাস্থল থেকে গুলিভর্তি আগ্নেয়াস্ত্র এবং রামদাসহ দেশীয় ধারাল অস্ত্র উদ্ধার করে। তবে লিমন কার গুলিতে আহত হয় তা তাত্ক্ষণিক জানা যায়নি বলে র্যাবের দাবি। ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, স্থানীয় থানায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লিমন জামিনপ্রাপ্ত একজন চার্জশিটভুক্ত আসামি। তার বিরুদ্ধে রাজাপুর থানার মামলা নম্বর ০৫, তারিখ ৩/১২/২০০৯, ধারা : ১৪৩/৩৪১/৩২৩/৩২৪/৩৭৯/৫০৬ রুজু রয়েছে এবং ওই মামলায় গত ১০ জানুয়ারি সে জামিন পায়। এ ব্যাপারে আমার দেশ-এর রাজাপুর প্রতিনিধি রাজাপুর থানার ওসি তোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ওসি জানান, লিমনের নামে এক বছর আগের একটি মারামারি মামলা রয়েছে এবং এ মামলায় শুরু থেকেই সে জামিনে আছে। এমন কোনো গুরুতর অভিযোগ বা মামলা তার নামে নেই।
উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি ঘটনা : চলতি বছর ২০ জানুয়ারি রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় র্যাব-১-এর গুলিতে মধ্যবাড্ডার জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে শামসুর রহমান শিমু (২২) এবং মেরুল বাড্ডার হাতিরঝিল এলাকার আবুল বাশারের ছেলে ঈসরাফিল আলম (২০) আহত হয়। র্যাব তখন বলেছিল, গুলিবিদ্ধ দুই যুবক পেশাদার ছিনতাইকারী। ২৪ মার্চ কমলাপুর স্টেডিয়ামের কাছে র্যাব-৩-এর গুলিতে আহত হয় দুই কিশোর সানি (১৮) ও আরিফ (১৭)। র্যাবের দাবি, গুলিবিদ্ধ দু’জনই ছিনতাইকারী। ৩০ মার্চ পুরানাপল্টনে র্যাবের গুলিতে রুবেল (১৮) ও সোহেল (২০) নামে দুই কিশোর আহত হয়েছে।
গত বছর ৯ ফেব্রুয়ারি সবুজবাগের মাদারটেক এলাকায় র্যাবের গুলিতে রুবেল হোসেন (২০) নামে এক যুবক আহত হয়। ২৬ নভেম্বর মতিঝিল আইডিয়াল ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের সামনে র্যাবের গুলিতে আহত হয় তিন যুবক। এরা হচ্ছে ইসমাইল হোসেন বিল্লাল, ফারুক হোসেন এবং মামুন। র্যাব কর্মকর্তারা আহত তিন যুবককে ছিনতাইকারী দাবি করলেও তাদের পরিবার র্যাবের অভিযোগ অস্বীকার করে। ২৭ সেপ্টেম্বর ছিনতাইকারী সন্দেহে র্যাব ও পুলিশের গুলিতে তিনজন আহত হয়। আগারগাঁও এলাকায় ছিনতাইকারী সন্দেহে গুলি করে সুমন ওরফে পিচ্চি সুমন (২২) এবং জামাল হোসেন (২৪) নামে দুই কিশোরকে আটক করে র্যাব। র্যাবের দাবি তাদের কাছ থেকে ২টি গুলিসহ আমেরিকায় তৈরি একটি পিস্তল, একটি দেশীয় পাইপগান ও একটি ধারাল ছুরি উদ্ধার করা হয়। অন্যদিকে গেণ্ডারিয়া এলাকায় ছিনতাইকারী সন্দেহে ফয়সাল (২৩) নামে এক যুবককে গুলি করে আটক করে পুলিশ।
এর আগে পুরনো ঢাকার কোতোয়ালি এলাকায় পুলিশের গুলিতে আহত হয় কালু মিয়া নামে এক যুবক। পুলিশ জানায়, কালু মিয়া এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী। স্থানীয়রা বলেছিলেন, কালুকে আটকের পর চোখ বেঁধে তাতীবাজার প্রসন্ন পোদ্দার লেনের একটি নির্মাণাধীন বাড়িতে নিয়ে বাঁ পায়ে দু’রাউন্ড গুলি করে পুলিশ। কালুর আত্মীয়-স্বজনরা পুলিশের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ করেন। একই বছর ১৯ জুলাই মিরপুরে পুলিশের গুলিতে শ্রমিক নেতা রফিকুল ইসলাম রুমীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় তার সহযোগী জহিরুল আলমও গুলিবিদ্ধ হয়। পুলিশ জানায়, রুমি ডাকাত ছিল। অপরদিকে আত্মীয়-স্বজনের দাবি রুমি ডাকাত কিংবা অপরাধী ছিল না। সেদিন পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিও হয়নি। রুমিকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। স্বজনরা আরও জানান, রুমি বিমানবাহিনীর সাবেক সার্জেন্ট ছিল। সায়েদবাদ-ক্যান্টনমেন্ট সড়কের শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ও জিয়া বিমানবন্দর থানা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবের সভাপতি ছিল সে। এর আগে বিয়ের আসর থেকে ফেরার পথে নৃত্য শিল্পীসহ চারজনকে ছিনতাইকারী সন্দেহে গ্রেফতার করে গুলি করে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। এ ছাড়াও ছিনতাইকারী সন্দেহে পুলিশ, র্যাব ও ডিবি সদস্যদের গুলিতে আরও বহু মানুষ আহত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পল্লবীতে রুবেল, আমিনুল ইসলাম, কাকলীতে মকবুল হোসেন, হাফিজুর রহমান, বনানীতে আনোয়ার হোসেন, আদাবরে মোবারক হোসেন, হীরা, তেজগাঁওয়ে জাহাঙ্গীর হোসেন, উজ্জ্বল, সূত্রাপুরে সেলিম, মোহাম্মদপুরে সবুজ মিয়া ও সেলিম।
মানবাধিকার সংস্থার উদ্বেগ ও প্রতিবাদ : র্যাবের গুলিতে পা হারিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে চিকিত্সাধীন ঝালকাঠির কলেজছাত্র লিমনের ঘটনায় আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) গভীর উদ্বেগ এবং প্রতিবাদ জানিয়েছে। এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, লিমনকে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করলেও তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ তা র্যাব পরিষ্কার করতে পারেনি। এমনকি তাকে গুলি করার পর র্যাব তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা করলেও তদন্তকারী কর্মকর্তা এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগের প্রমাণ পায়নি। লিমনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে র্যাবের দায়িত্ব ছিল তাকে বিচার প্রক্রিয়ায় সোপর্দ করা। কিন্তু তা না করে প্রকাশ্যে গুলি করে র্যাব বিচার ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে, যা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার শামিল। সেইসঙ্গে র্যাব আইনের রক্ষক থেকে ভক্ষকে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের (বামাক) চেয়ারম্যান বিচারপতি একেএম সাদেক এবং মহাসচিব দিলদার এক বিজ্ঞপ্তিতে র্যাব কর্তৃক এইচএসসি পরীক্ষার্থী লিমনকে গুলি করা এবং পরে তার পা কেটে ফেলার ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এই নিষ্ঠুরতম ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত এবং দায়ী র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে জরুরি আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়।

বিচার বিভাগে দলীয়করণ : বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি : বিচারবহির্ভূত হত্যা গুম ও অপহরণ বেড়েই চলেছে








বশীর আহমেদ
মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টে বাংলাদেশে বিচার বিভাগ দলীয়করণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েই চলেছে। তাদের হাতে গুম ও অপহরণ অব্যাহতভাবে চলছে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর রাজনৈতিক সহিংসতা, হয়রানি ও নির্যাতন বেড়েই চলেছে। সভা-সমাবেশের অধিকারকে সীমিত করা হয়েছে। সরকার গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করছে এবং সাংবাদিকরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সাধারণ মানুষের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর থেকে প্রকাশিত ২০১০ সালের মানবাধিকার রিপোর্টে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের গত বছরের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সংবলিত এই রিপোর্ট ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশ করা হয়।
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ৪২ পৃষ্ঠার রিপোর্টে সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নির্যাতন, গণমাধ্যম দলনসহ মানবাধিকারের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। রিপোর্টে বাংলাদেশের জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক আমার দেশ বন্ধ করে দেয়া, পত্রিকাটির সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার ও আদালত অবমাননা মামলায় সাজা এবং সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমানকে সাজা দেয়ার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পায়।
মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েই চলেছে। আটক অবস্থায় মৃত্যু, নির্যাতন, অযৌক্তিকভাবে গ্রেফতার এবং ডিটেনশনের জন্য এই নিরাপত্তা বাহিনী দায়ী। বিচারবহির্ভূত এসব হত্যা এবং বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত র্যাবের ব্যাপারে কোনো ধরনের তদন্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। এটা গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্য এ ধরনের অপরাধ করেছে এই নিশ্চয়তা নিয়ে যে, তাদের কোনো শাস্তি হবে না। বিচারের আগেই কারাগারে মৃত্যুঝুঁকির পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কর্তৃপক্ষ নাগরিক অধিকারকে উপেক্ষা করেছে। বিচার বিভাগকে অব্যাহতভাবে রাজনীতিকরণ করায় বিচার ব্যবস্থায় বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে। এর ফলে বিশেষ করে বিরোধী দলের জন্য এখন ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার গণমাধ্যম এবং জনগণের বাকস্বাধীনতাকে সীমিত করে ফেলেছে। গণমাধ্যমগুলো সেলফ সেন্সরশিপ করতে বাধ্য হচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রতিনিয়ত হয়রানি করছে সাংবাদিকদের। সরকার সভা-সমাবেশের অধিকারকে সীমিত করেছে এবং অব্যাহত
রয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা। এটা এখন একটি বড় সমস্যা।
সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি অব্যাহত গতিতে চলছে এবং দুর্নীতির সঙ্গে যারা যুক্ত, তারা শাস্তির বাইরে থেকে যাচ্ছে। নারীর প্রতি বৈষম্য এবং নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা একটি ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে বাংলাদেশে। মানব পাচার এখনও বড় সমস্যা।
বিচারবহির্ভূত হত্যা : মার্কিন এ রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা অব্যাহতভাবে ঘটে চলেছে। এসব হত্যার কোনো ধরনের পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে রাজি হয়নি সরকার। ২০১০ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে ১২৭টি। এর মধ্যে ক্রসফায়ারই ১০১টি। র্যাব কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে ৬৮টি। আগের বছর র্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ছিল ৪১টি। এসব হত্যার ঘটনা তদন্তের জন্য সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
গুম ও অপহরণ : ২০১০ সালে বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুম এবং অপহরণের ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এ ব্যাপারে সঠিক পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও প্রচুর ঘটনা ঘটেছে। অনেক অপহরণের ঘটনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। অন্তত ৯টি গুমের ঘটনার সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনী জড়িত। কিছু ঘটনার সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যক্তিগত লোকজন জড়িত।
গুমের কয়েকটি ঘটনার বিবরণ দিয়ে রিপোর্টে বলা হয়, ২০১০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর থেকে মোহাম্মদ সেলিম নামে এক ফল ব্যবসায়ীকে র্যাব সদস্যরা তুলে নিয়ে যায়। এখন পর্যন্ত তার কোনো হদিস মেলেনি। ১৯ মার্চ ঠাকুরগাঁও থেকে র্যাব সদস্যরা আখতার সানী সরদারকে আটক করে। কিন্তু তারও কোনো খোঁজ মেলেনি। ২৫ জুন ওয়ার্ড কমিশনার মোহাম্মদ চৌধুরী আলমকে অপহরণ করা হয়। সরকার এখন পর্যন্ত চৌধুরী আলমকে উদ্ধার বা তার অপহরণকারীদের গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়েছে। চৌধুরী আলমকে আগে একবার অপহরণের চেষ্টা করা হয়। তখন ওই অপহরণ চেষ্টার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা ছিল র্যাবের এজেন্ট এবং তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
রাজনৈতিক সহিংসতা : বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর রাজনৈতিক সহিংসতা, হয়রানি ও নিপীড়ন অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। গত এক বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় ২২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্বেও হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক সহিংসতায় আহত হয়েছে কমপক্ষে ১৩ হাজার ৯৯৯ জন।
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে ২০১০ সালে ৫৭৬টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এসব সহিংস ঘটনায় ৩৮ জন নিহত এবং ৫ হাজার ৬১৪ জন আহত হয়। এ সময় বিএনপির অভ্যন্তরীণ সহিংসতায় ৭ জন নিহত এবং আহত হয় ৯৪৬ জন।
বিচার বিভাগ দলীয়করণ : প্রতিবেদনে বলা হয়, যদিও নির্বাহী বিভাগ থেকে বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে আলাদা করা হয়েছে, তারপরও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষই উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ দিচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক স্পর্শকাতর মামলার রায় রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। এ ঘটনা ঘটছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিরোধীদের জামিন ও ডিটেনশন দেয়ার ক্ষেত্রে। সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকার গত বছরের ১১ এপ্রিল ১৭ জন অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ দেয়। এদের মধ্যে দু’জনের বিরুদ্ধে অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
ওই দুই বিচারপতিকে তত্কালীন বিদায়ী প্রধান বিচারপতি ফজলুল করিম শপথ পড়াতে অস্বীকার করেন। ২৬ সেপ্টেম্বর সিনিয়র দুই বিচারপতিকে ডিঙিয়ে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে সরকার প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়। বিরোধী দলের নেতারা ওই নিয়োগের সমালোচনা করে বলেন, সরকারি দলের প্রতি অনুগত হওয়ার কারণেই তাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই প্রধান বিচারপতির এমন সময়ে অবসরে যাওয়ার কথা রয়েছে, যার ফলে তিনিই হবেন আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকবে ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ : মার্কিন মানবাধিকারের এ প্রতিবেদনে গণমাধ্যম দলনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানে গণমাধ্যম এবং বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলেও তা রক্ষায় বর্তমান সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের সমালোচনা করায় ইলেকট্রনিক মাধ্যমসহ দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রচণ্ড চাপ ও হুমকির মধ্যে রয়েছে। বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় চ্যানেল ওয়ান গত বছর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গত ১ জুন ঢাকা জেলা প্রশাসকের নির্দেশে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল দৈনিক আমার দেশ। গ্রেফতার করে ডিটেনশনে পাঠানো হয় পত্রিকাটির সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। পরে পুলিশের মামলায় দীর্ঘ সময় কারাগারে আটক রাখা হয় আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। আমার দেশ এক মাসেরও বেশি বন্ধ থাকার পর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে সরকারের সিদ্ধান্ত স্থগিত হওয়ায় পুনরায় পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। তবে পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কারাগারেই আটকে রাখা হয়।
আদালতের সমালোচনা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় ১৯ আগস্ট মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এক মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয় প্রতিবেদক অলিউল্লাহ নোমানকে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই প্রথমবারের মতো আদালত অবমাননার অভিযোগে আপিল বিভাগ কোনো সাংবাদিককে কারাদণ্ড দিলেন। রিপোর্টে বলা হয়, জনপ্রিয় টক শো ‘পয়েন্ট অব অর্ডার’ ডিজিএফআইর প্রতিনিয়ত হুমকির কারণে শেষ পর্যন্ত বন্ধ করতে বাধ্য হয়। রিপোর্টে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা একটি বড় সমস্যা হিসেবেই দেখা দিয়েছে। সরকার এবং সরকারি দলের সদস্যরা প্রতিনিয়ত সাংবাদিকদের হয়রানি করছেন। ২০১০ সালে অন্তত ৪ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১১৮ জন। আক্রমণের শিকার হয়েছেন ৪৩ জন।
সীমান্ত হত্যা : মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টে সীমান্ত হত্যার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১০ সালে সীমান্ত হত্যা ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ৯৮ বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করেছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু : ২০১০ সালে বাংলাদেশের কারাগারে মারা গেছে ৪৬ জন এবং পুলিশ কাস্টডিতে মারা গেছে ১০৯ জন। বাংলাদেশের কারাগারগুলোর ধারণক্ষমতা ২৯ হাজার ২৪০ জন। অথচ এসব কারাগারে আটকের সংখ্যা ছিল ৬৯ হাজার ৬৫০ জন।

অধিকারের রিপোর্ট : প্রতি ৩ দিনে একজন বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার










স্টাফ রিপোর্টার
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে প্রতি তিন দিনে গড়ে একজন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার তাদের ত্রৈমাসিক রিপোর্টে এ তথ্য জানিয়েছে। এছাড়া এই তিন মাসে মানবাধিকার লঙ্ঘনের আলোচিত ঘটনার মধ্যে ছিল বিএসএফের গুলিতে নিহত বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানীর কাঁটাতারে ঝুলন্ত লাশ, জামিনে মুক্ত হয়েই উপজেলা চেয়ারম্যান হত্যার ১১ আসামির বাদীকে হুমকি, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক খুনের আসামির দণ্ড মওকুফ করা, রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহার, দেশব্যাপী রাজনৈতিক সহিংসতা, র্যাব ধরে নিয়ে যাওয়ার পর নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ, দুদককে দুর্বল করার লক্ষ্যে সংসদে বিল উত্থাপন করা, ল্যাম্পপোস্ট, ছাত্র গণমঞ্চ ও আড়িয়ল বিল রক্ষা কমিটির সভা পণ্ড করা, আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের প্রতিবাদে এলাকাবাসী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ, আন্দোলনকারী জনগণের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও হয়রানি, মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এুর প্রকল্প ছাড়ে সরকারের অনীহা ও এর মানবাধিকার কর্মীদের হয়রানির সম্মুখীন হওয়া, পৌরসভা নির্বাচন, দুটি সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মানবাধিকার লঙ্ঘন, সন্ত্রাস দমন আইনে গ্রেফতার এবং রাজনৈতিক কারণে বন্দিদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় ‘আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার’ আদায়ের সংগ্রামে নিয়োজিত নেতাদের ভারতের কাছে হস্তান্তর, শিশুদের দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি ও ভিক্ষুক উচ্ছেদ, নারীর প্রতি সহিংসতা ও পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা।
অধিকার-এর ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৩৩ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। অর্থাত্ গড়ে প্রতি তিন দিনে একজন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। গত ২৬ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ নিয়ে যে যাই বলুক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের কাজ করে যাবে। আত্মরক্ষায় তাদের ছোড়া গুলিতে সন্ত্রাসীদের মরাই স্বাভাবিক। সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি নিরীহ মানুষও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। গত ১১ জানুয়ারি ঢাকার পল্লবীতে পুলিশের গুলিতে ইমতিয়াজ হোসেন আবীর (১৯) নামে নর্দান কলেজের ১ম বর্ষের একজন ছাত্র নিহত হয়েছে। নিহতের পরিবার অভিযোগ করেছে, পুলিশ সদস্যরা আবীরকে হত্যা করেছে। আবীরের নামে থানায় কোনো মামলা বা জিডি নেই।
অধিকার আরও জানায়, গত ৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমি সব সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ছিলাম। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এটা রাতারাতি বন্ধ করা সম্ভব নয়।’ প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেয়ার দিনই পাবনায় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (লাল পতাকা) আবদুল হামিদ ও এর পরদিন ঢাকার মিরপুরে বোটানিক্যাল গার্ডেনে নুরুল ইসলাম সুমন নামে এক যুবক পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন।
সীমান্তে বিএসএফের আগ্রাসন অব্যাহত থাকার কথা উল্লেখ করে অধিকার জানায়, আগের বছরগুলোর মতো এবছরও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। বিএসএফ নিরস্ত্র নারী, পুরুষ, শিশুকে হয় গুলি করে হত্যা করেছে, নির্যাতন করে আহত করেছে, অথবা অপহরণ করেছে। গত ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তের ৯৪৭ আন্তর্জাতিক সীমানা পিলারের কাছ দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরার সময় ফেলানী খাতুন (১৫) নামে এক কিশোরীকে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করে এবং পাঁচ ঘণ্টা তার লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় রাখার পর ভারতে নিয়ে যায়। এর ৩০ ঘণ্টা পর বিএসএফ ফেলানীর লাশ বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে।
অধিকার আরও জানায়, বিএসএফ গত ১ জানুয়ারি ২০০০ থেকে ৩১ মার্চ ২০১১ পর্যন্ত ৯০৭ জন নিরস্ত্র নাগরিককে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
উপজেলা চেয়ারম্যান হত্যার ১১ আসামি জামিনে মুক্ত হয়েই হুমকি দেয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সংগঠনটি জানায়, গত বছরের ৮ অক্টোবর নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা সানাউল্লাহ নূর ওরফে বাবুকে মিছিলের ওপর হামলা চালিয়ে প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। জেলা আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক জাকির হোসেনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের বড়াইগ্রাম উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম, যুবলীগ নেতা রাকিব, জামিল ও বাবুলসহ একদল দুর্বৃত্ত এই হামলা চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর গত ৬ মার্চ বিচারপতি মো. শামসুল হুদা ও বিচারপতি আবু বক্কর সিদ্দিকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ নাটোরের মুখ্য বিচারিক হাকিমের সন্তুষ্টি সাপেক্ষে ১১ আসামির ছয় মাসের জামিন মঞ্জুর করেন। আসামিরা জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তাদের বিশাল সংবর্ধনা দেয়া হয় এবং সেখানে তারা হুমকি দেন। অধিকারের তথ্যমতে, ২০০১ থেকে ২০০৬ মেয়াদে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময়ে ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা’ হিসেবে পাঁচ হাজার ৮৮৮টি মামলা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং ৯৪৫টি মামলা থেকে কিছু কিছু আসামিকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় মোট ৭৩ হাজার ৫৪১ জন অভিযুক্তকে খালাস দেয়া হয়।
গণপিটুনির পরিসংখ্যান তুলে ধরে সংগঠনটি জানায়, গত তিন মাসে ৩৭ ব্যক্তি গণপিটুনিতে মারা গেছে। এছাড়া রাজনৈতিক সহিংসতায় ৩০ জন নিহত ও ২ হাজার ৫২৭ জন আহত হয়েছে। এ সময়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ৯০টি এবং বিএনপির ২০টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এছাড়া আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ৪ জন নিহত ও ১ হাজার ১৩৫ জন আহত হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ১ জন নিহত ও ১৯১ জন আহত হয়েছে।
সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী ও জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে সরকারের অনুমোদন লাগবে, এমন বিধান রেখেই গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সংসদে উত্থাপিত হয়েছে ‘দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) আইন, ২০১১’ বিল। অধিকার মনে করে, বিলটি অনুমোদিত হলে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতি আরও ব্যাপক আকার ধারণ করবে বলে অধিকার আশঙ্কা প্রকাশ করছে।
অধিকার-এর প্রকল্প ছাড়ে সরকারের অনীহা ও এর মানবাধিকার কর্মীরা হয়রানির সম্মুখীন হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সংগঠনটি। তারা জানায়, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক অধিকার প্রতিনিয়ত হয়রানির সম্মুখীন হচ্ছে। সরকারি সংস্থা এনজিও বিষয়ক ব্যুরো একদিকে যেমন অধিকার-এর দুটো মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রকল্প ছাড় না দিয়ে যথাক্রমে ৮ ও ৩ মাস ধরে আটকে রেখেছে, অন্যদিকে অধিকারের মানবাধিকার কর্মীরা সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে রয়েছেন।
সংবাদ মাধ্যম সরকারের রোষানলে পড়ার কথা উল্লেখ করে অধিকার জানায়, নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত স্থানীয় পত্রিকা দৈনিক যুগের চিন্তার সম্পাদক ও প্রকাশক মোরছালীন বাবলাকে এমপি নাসিম ওসমান ও আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান হুমকি দেন। এছাড়া গত ৩ মাসে ২০ জন সাংবাদিক আহত, ২০ জন হুমকির সম্মুখীন এবং ১০ জন লাঞ্ছিত হয়েছেন।
‘আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার’ আদায়ের সংগ্রামে নিয়োজিত নেতাদের ভারতের কাছে হস্তান্তরের বিষয়টি উল্লেখ করে অধিকার জানায়, ভারতের ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা)-এর তিন নেতা ক্যাপ্টেন অন্তু চাউদাং, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট প্রদীপ চেটিয়া এবং করপোরোল সৌরভকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যরা। বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক অন্যদেশের মুক্তিকামী নিপীড়িত জনগণের সংগ্রামকে স্তব্ধ করার ভূমিকায় অধিকার উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
জানুয়ারি-মার্চ মাসে মোট ২০৩ নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন, নিহত ১ জন, আহত ২৪ জন, লাঞ্ছিত ৪৩ জন, অপহরণ ৬ জন, ধর্ষণের অপচেষ্টার শিকার ৩ নারী। নারীর প্রতি যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৭৮ পুরুষ সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ৪ পুরুষ বখাটে বা তাদের পরিবারের সদস্যদের আক্রমণে নিহত এবং ৭৪ পুরুষ আহত হয়েছেন। এই সময়কালে ১৪ নারী যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটে কর্তৃক আহত ও ১ জন লাঞ্ছিত হয়েছেন।
মানবাধিকার রক্ষায় নির্বাচনী ইশতেহার এবং জাতিসংঘে দেয়া ঘোষণা অনুযায়ী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা, সরকারকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের সম্মুখীন করাসহ বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বিএসএফের হাতে নিহত ফেলানীসহ অন্য সব হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের ঘটনাগুলো সরেজমিনে অনুসন্ধান করে বাংলাদেশ সরকারকে ভিকটিমদের পরিবারগুলোকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে ভারত সরকারকে বাধ্য করার উদ্যোগ নেয়া

সংবাদ সম্মেলনে রবার্ট ব্লেকের হুশিয়ারি : ইউনূসের বিষয়ে সমঝোতা না হলে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে














কূটনৈতিক রিপোর্টার

ড. মুহম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সমঝোতা না হলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপন্থীয় সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সফররত দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এই হুশিয়ারি দেন।
প্রভাবশালী এই মার্কিন কূটনীতিক বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন।
আমেরিকান ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ড. ইউনূস প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে রবার্ট ব্লেক বলেন, ড. মুহম্মাদ ইউনূসকে অহেতুক গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে বিতাড়ন করা হয়েছে। এটা আমাদের জন্য চরম অস্বস্তির। আমরা চাই ড. ইউনূস ইস্যুতে সন্তোষজনক সমঝোতা, যেখানে গ্রামীণ ব্যাংকের স্বাধীন কার্যকারিতা নিশ্চিত হবে। আমরা মনে করি, সমঝোতার সুযোগ এখনও রয়েছে। আর যদি ড. ইউনূসের সঙ্গে সরকারের সমঝোতা না হয়, তা হলে দু’দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ড. ইউনূসের সঙ্গে সরকারের সমঝোতার উপায় কী হতে পারে সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের জবাবে রবার্ট ব্লেক বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এখানে কোনো ফর্মুলা দেবে না। এটা ড. ইউনূস, গ্রামীণ ব্যাংক এবং সরকারের ব্যাপার। আমরা চাই দুই পক্ষ আলোচনার বসুক। ড. ইউনূসের সঙ্গে সরকার আলোচনার মাধ্যমে সন্তোষজনক সমাধান বের করতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
ড. ইউনূস ইস্যু বাংলাদেশের একটি অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের এত আগ্রহ কেন সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের জবাবে ব্লেক বলেন, ড. ইউনূস আন্তর্জাতিকভাবে একজন সম্মানিত ব্যক্তি। নোবেল বিজয়ী এই ব্যক্তিত্ব লাক লাখ মানুষকে দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্ত করেছেন। মার্কিন জনগণ, মার্কিন সুশীল সমাজ, মার্কিন কংগ্রেস সদস্য, কংগ্রেসের বাংলাদেশ ককাসের সদস্য, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ড. ইউনূসকে গভীরভাবে ভালোবাসেন এবং শ্রদ্ধা করেন। ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেন অব ফ্রিডম-এ ভূষিত হয়েছেন। কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেনের জন্য তিনি এখন মনোনীত। এসব কারণেই ড. মুহম্মাদ ইউনূসকে নিয়ে আমাদের এই আগ্রহ। রবার্ট ব্লেক আরও বলেন, আমরা বাংলাদেশে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলাম। যাতে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং স্বাধীন সুশীল সমাজ বিকাশ লাভ করে। ড. ইউনূসকে যেভাবে সরানো হয়েছে তাতে সুশীল সমাজকে হেয় করা হযেছে। এটা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন যুক্তরাষ্ট্র সফরে প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে সাক্ষাত্ এবং হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর বাতিল প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রবার্ট ব্লেক বলেন, ড. ইউনূস ইস্যুতে আগামীতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে, সে ব্যাপারে এখন কোনো মন্তব্য করতে চাই না। ড. ইউনূসের সঙ্গে সরকারের সমঝোতা হলেই কেবল আমি হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের বিষয়টি উপস্থাপন করতে পারব।
যুক্তরাষ্ট্র ড. ইউনূস ইস্যুতে ব্যাপক সোচ্চার হলেও বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় নীরব কেন এই প্রশ্নের জবাবে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মানবাধিকার আমাদের কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এই ইস্যু নিয়ে আমরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে অনেকবার আলোচনা করেছি। এ ব্যাপারে আমরা আমাদের উদ্বেগের কথাও জানিয়েছি। বিশেষ করে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গণতন্ত্র, সুশাসন ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নের ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছিল। বিষয়গুলো কী সঠিক পথে এগুচ্ছে এই প্রশ্নের জবাবে রবার্ট ব্লেক বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে। তবে আরও অনেক কিছু করার রয়েছে। দুর্নীতি দমন এখানে উল্লেখ করার মতো বিষয়।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে ঢাকায় তার বৈঠক সম্পর্কে জানতে চাইলে রবার্ট ব্লেক বলেন, এই অঞ্চলে সন্ত্রাস দমনে মার্কিন কৌশল নিয়ে মূলত আলোচনা হয়েছে। সন্ত্রাস দমনে কী কী করা যায় তা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি।
মানব পাচার রোধে বাংলাদেশকে সহায়তা দেয়াসহ মার্কিন বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশধিকারের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক মনোভাবের কথা জানান রবার্ট ব্লেক। ড. ইউনূস ইস্যু নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯ মার্চ রবার্ট ব্লেক ৫ দিনের সফরে ঢাকা আসেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া, অর্থমন্ত্রী ড. আবুল মাল আবদুল মুহিত, ড. মুহম্মাদ ইউনূস এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। আজ সকালে রবার্ট ব্লেক ঢাকা ছেড়ে যাবেন