Wednesday 29 December 2010

পুলিশের কাজে বাধাদান’ : বিরোধী নেতাকর্মীদের ফাঁসানোর নতুন অস্ত্র


নাছির উদ্দিন শোয়েব
তুচ্ছ ঘটনা নিয়েও এখন দেশে মামলা হচ্ছে। পুলিশের দায়িত্ব পালনে বাঁধা দেয়ার অভিযোগ এনে মামলা করে আসামি করা হচ্ছে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের। বিরোধী মতের লোকজনকে এসব মামলায় ফাঁসিয়ে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন করা হচ্ছে। এমনকি আদালতের পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ হানা দিয়ে যে কাউকে গ্রেফতার করছে। যাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে ওই ব্যক্তি পুলিশের কাজে বাধা তো দূরের কথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘটনা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। এমনকি ঘটনাস্থলেও তিনি উপস্থিত ছিলেন না। অথচ মামলার আসামি হচ্ছেন তিনি। পুলিশের এ ধরনের মামলায় নাজেহাল হচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু সরকারি দলের এমপি ও ক্যাডাররা যখন পুলিশের ওপর হামলা চালায়, থানার ওসিকে চড়থাপ্পড় দেয়, থানার ভেতরে ঢুকে পুলিশকে হুমকি দেয়, আসামি ছিনিয়ে নেয় তখন পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার মামলা হয় না। দু’একটি মামলা হলেও কেউ গ্রেফতার হয় না।
এ ব্যাপারে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া জানান, পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার ঘটনায় দায়ের করা অধিকাংশ মামলা আদালতে টেকে না। কারণ এসব মামলার বেশিরভাগই অসত্য। মিথ্যা এজাহার দাখিল করায় আদালতে আসামি খালাস পেয়ে যায়। তিনি বলেন, পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার ঘটনায় দণ্ডবিধির ৩৩২, ৩৩৩ ও ৩৫৩ ধারায় মামলা করা যায়। এ মামলায় সর্বোচ্চ ৩ বছর সাজা দেয়ার বিধান রয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বর্তমানে আদালত এসব মালায়ও দফায় দফায় রিমান্ড মঞ্জুর করছেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ডিসি মনিরুল ইসলাম বলেন, মিথ্যা অভিযোগে এখন পর্যন্ত মামলা করার কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় বিচারক আসামির রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই। তিনি আরও বলেন, রিমান্ডে এনে গোয়েন্দা কার্যালয়ে কাউকে নির্যাতন করা হয়েছে এ কথা কেউ বলতে পারবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার ঘটনায় বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া এজাহারগুলোর বেশিরভাগই অসত্য। প্রতিপক্ষের লোকজনকে ঘায়েল করতে পুলিশকে দিয়ে ফরমায়েশি মামলা করানো হয়। রাজনৈতিক প্ররোচনায় এর কলকাঠি নাড়ছেন পুলিশের ঊর্ধতন কিছু কর্মকর্তা। পুলিশকে দিয়ে সাজানো মামলা করে প্রতিপক্ষকে সহজেই ঘায়েল করার কৌশল নেয়া হচ্ছে। ফলে অনেক মামলাই তত্ক্ষণাত্ দায়ের করা হয় না। ঊর্ধ্বতন মহলের ইঙ্গিতে মামলাগুলো দায়ের করা হয়। কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের সময় তার পক্ষের লোকজন বিক্ষোভ মিছিল করলেও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে মামলা হয়। এমনকি আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে বিচারকের এজলাসে থাকা অবস্থায় বাইরে বিক্ষোভের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আটক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে এমন নজিরও রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাষ্ট্রের কল্যাণে প্রশাসন বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ করে থাকে। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, অপরাধীকে আইনের হাতে সোপর্দ করা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর রুটিন ওয়ার্ক। এ ছাড়াও দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে এ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ভূমিকা, বিশৃঙ্খলা ও সন্ত্রাস দমন এবং উগ্রবাদ নির্মূলে সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান বাধা দিলেই কেবল পুলিশের কাজে বাধা দেয়া হয়। অন্যথায় নয়। সঠিক তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে হয়রানি করা নিশ্চয়ই পুলিশের কাজ নয়। আদালতের রায় কিংবা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই কেবল আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের হয়রানি করতে পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার কাল্পনিক কাহিনী ফেঁদে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হচ্ছে এমন বহু অভিযোগ রয়েছে। রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার রহস্য উদঘাটনের জন্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত জুনে দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগ এনে কাল্পনিক মামলা দায়ের করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। মধ্যরাতে পুলিশ আমার দেশ সম্পাদককে গ্রেফতার করতে গেলে কর্মরত সাংবাদিকরা ওয়ারেন্ট দেখতে চান। এ নিয়ে সাংবাদিক ও পুলিশের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয় এবং জোরপূর্বক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করতে চাইলে সাংবাদিকরা প্রতিবাদ করেন। পরে পত্রিকার প্রকাশক হাসমত আলীর অভিযোগ থেকে খালাস পেলেও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে মাহমুদুর রহমানকে আসামি করা হয় এবং কর্মরত ৫ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। এ মামলায় মাহমুদুর রহমানকে রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালায় পুলিশ। এরপর মাহমুদুর রহমানকে আদালতে হাজির করার সময় আইনজীবীদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ বাধা দিলে সেখানে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এতেও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে মামলা হয়।
গত ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং দলের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বেআইনি সমাবেশ, পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেয়া, পুলিশকে মারধর এবং ভাংচুরের অভিযোগে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এসব মামলা করা হয়। জামায়াতের তিন নেতাকে পল্টন থানায় দায়ের করা তিনটি মামলায় তিন দিন করে রিমান্ড আদেশ দেন আদালত। মামলায় এ তিন নেতার নাম না থাকলেও জামায়াত-শিবিরের সমাবেশে উপস্থিত থেকে এসব ঘটনা ঘটান বলে রিমান্ড আবেদনে উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও গত ২৭ জুন হরতালে জামায়াত নেতাকর্মীরা পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেন এবং পুলিশের ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে পুলিশ সদস্যদের আহত করার অভিযোগ এনে রমনা থানায় ওইদিনই মামলা করা হয়। মামলায় এ তিন নেতার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে উল্লেখ করে রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ।
২৭ জুন হরতালে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ভাংচুর, সরকারকে অস্থিতিশীল করা এবং হত্যার উদ্দেশ্যে পুলিশকে গলা চেপে ধরার অপরাধে বিএনপি নেতা শমসের মুবিন চৌধুরী, মোস্তফা আহম্মেদ, মো. এলাহী, মো. বাবুল, সুলতান আহম্মেদ, মতিউর রহমান এলাহী এবং মো. মুসা কলিমুল্লাকে আসামি করে গুলশান থানায় মামলা করা হয় এবং তাদের রিমান্ডে নেয়া হয়।
১৬ নভেম্বর রাজধানীর গাবতলী মোড়ে ট্রাফিক কনস্টেবলকে মারধর করে আহত করা, পুলিশের দায়িত্ব পালনে বাধা এবং আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে চলচ্চিত্র অভিনেতা এবং ডিসিসির ৯ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার মনোয়ার হোসেন ডিপজলের বিরুদ্ধে দারুস সালাম থানায় মামলা করে পুলিশ। ২৮ নভেম্বর ডিপজল থানায় আত্মসমর্পণ করেন। এ মামলায় তাকে দুই দফা রিমান্ডে নেয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদে ট্রাফিক পুলিশকে মারধর এবং অস্ত্র দেখানোর বিষয়টি অস্বীকার করে ডিপজল বলেছেন, আলতাব হোসেন নামে ট্রাফিক পুলিশের ওই সদস্যের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়েছে। তিনি কাউকে মারধর করেননি বা অস্ত্র প্রদর্শন করেননি।
গত ২০ ডিসেম্বর বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া চীন যাওয়ার সময় হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে দলের নেতাদের হাতাহাতির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় একটি মামলা হয়েছে। শনিবার এ ঘটনা ঘটলেও একদিন পর রোববার রাতে মামলা করা হয়। মামলায় বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাজিম উদ্দিন আলম ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেলসহ ৬ নেতাকে আসামি করা হয়েছে। সিভিল অ্যাভিয়েশন নিরাপত্তা বিভাগের উপ-পরিচালক তোফাজ্জল হোসেন বাদী হয়ে এ মামলা করেন। এ ঘটনায় বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন বলেন, বিমানবন্দরে বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা অশোভন আচরণ করে উল্টো তারাই আবার মামলা করেছে।
ভিন্ন চিত্র : কিছুদিন আগে যশোরের শার্শা থানার এমপি শেখ আফিল উদ্দিন তার অনুমতি না নিয়ে হত্যা মামলা নেয়ায় থানার ওসিকে ডেকে নিয়ে পিটিয়েছেন বলে জানা গেছে। ওসির জামার কলার ধরে বেধড়ক পিটিয়ে কক্ষের মেঝেতে ফেলে কিল, ঘুষি, লাথি, থাপ্পড় মারে এমপির ক্যাডাররা। এছাড়াও এমপির খেদোক্তি ছিল আজ জানে মারলাম না, আমার কথামত কাজ না করলে মেরেই ফেলব। এ ঘটনার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওসিকে এলাকা ছেড়ে চলে যেতেও নির্দেশ দেন শেখ আফিল উদ্দিন। বিএনপি কর্মী আবদুল হামিদ খুন হওয়ার ঘটনায় আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়। পুলিশ ওই মামলার এজাহারভুক্ত এক আসামিকে গ্রেফতার করে। আর এতেই ক্ষিপ্ত হন এমপি শেখ আফিল উদ্দিন। ওসি এনামুল হক পরে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, বাসা থেকে ডেকে এনে এমপি আমাকে প্রথমে দু’তিনটি থাপ্পড় মারেন। আর এমপির ক্যাডার ঝিকরগাছার মুছা মাহমুদ আমার ইউনিফর্মের কলার চেপে ধরে তলপেটে দু’তিনটি লাথি মারে। এ সময় আমি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে মুছা লাথি মারতে মারতে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। গত মে মাসে পুরনো ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে মোটরসাইকেলের কাগজপত্র চেক করতে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতার তোপের মুখে পড়েন সূত্রাপুর থানার এএসআই সাইফুর রহমান। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ওই নেতার মোটরসাইকেলের কাগজপত্র দেখতে চান তিনি। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হলে সাইফুর রহমানকে টেনেহিঁচড়ে ক্যাম্পাসে নিয়ে একটি রুমে আটকে রেখে নির্যাতন চালায়।
১৭ জুলাই কামরাঙ্গীরচর থানার লোহার ব্রিজের ঢালে চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনকালে এসআই এবারত হোসেন কাগজপত্রবিহীন একটি মোটরসাইকেল আটক করে। ওই মোটরসাইকেলটি ছাড়িয়ে নিতে স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা জুম্মন ও মোহাম্মদ আলী পলাশ ঘটনাস্থলে আসে। এর আগে জুম্মন মোটর সাইকেলটি ছেড়ে দিতে পুলিশকে নির্দেশ দেয়। তার নির্দেশ অমান্য করায় ওই দুই নেতাসহ ১০-১৫ সন্ত্রাসী এসআই এবারত হোসেনকে মারধর করে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা কলেজের সামনে এক সার্জেন্টকে বেদম পেটায় কয়েক ছাত্রলীগ ক্যাডার। সম্প্রতি রাজধানীতে এক এমপির পিএস’র হাতে লাঞ্ছিত হন এক পুলিশ কর্মকর্তা। এর আগেও সংসদ সদস্যের হাতে পুলিশ মার খেয়েছে। ওইসব ঘটনার বিচার তো হয়নি বরং মামলা হওয়ায় পুলিশ কর্মকর্তাদের ক্ষমা চাইতে হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পুলিশের ওপর সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের এ নির্যাতন পুলিশের কাজে বাধার মধ্যে পড়ে না। দু’একটি ঘটনায় মামলা হলেও কোনো প্রকার অ্যাকশনে যায়নি পুলিশ প্রশাসন।

No comments:

Post a Comment