Saturday 26 June 2010

লোহার শিকের সাথে হাতকড়া লাগিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ



কবরের মতো ছোট অìধকার প্রকোষ্ঠে চোখ বেঁধে এবং লোহার শিকের সাথে হাতকড়া লাগিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে আমার দেশ সম্পাদক ও সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমানকে। গত বুধবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ১০ ঘন্টা এভাবেই তাকে টিএফআই সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গতকাল আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি এসব কথা বলেন। মাহমুদুর রহমান আদালতের উদ্দেশে প্রশ্ন রেখে বলেন, টর্চারের ‘ডেফিনেশন’ (সংজ্ঞা)-এ কী আছে তা আপনারা ভালো বলতে পারবেন। আমি যতদূর জানি, বাংলাদেশ ‘ইউনাইটেড নেসন্স’র ‘কনভেনশন এগেইনেস্ট টর্চার’-এ স্বাক্ষর করেছে। এতে সই করার পর কোনো সরকার তার যেকোনো নাগরিকের সাথে এ ধরনের আচরণ করতে পারে কি না? এ ছাড়া সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চোখ বেঁধে রাখার কোনো আইনি বিধান আছে কি না? এটা বিবেচনা করার দায়িত্ব মাননীয় আদালতের।
বিমানবন্দর থানার দায়েরকৃত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চার দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল তাকে আদালতে আনা হয়। এ নিয়ে চারটি মামলায় তিনি ১২ দিন রিমান্ডে ছিলেন। গতকাল আদালতের নির্দেশে তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়।
আদালতের অনুমতি নিয়ে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘বুধবার সকাল সাড়ে ৬টায় আমাকে ডিবি অফিস থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। বলা হয়, এটা র‌্যাব-১ অফিসের টিএফআই সেল। ওই সেলে নিয়ে আমার হাতকড়া পরানো হয় এবং আমার চোখ বাঁধা হয়। সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আমাকে চোখ বেঁধে এবং হাতকড়া বেঁধে রাখা হয়। এটা আইনের বিধান কি না মাননীয় আদালত আপনারা বিবেচনা করবেন। এখানে আইনের লোকজন আছেন। তা দেখবেন। সারা বাংলাদেশে আইনকে কোথায় নিয়ে যেতে চাওয়া হচ্ছে তা আপনারা বিবেচনা করবেন।’ তিনি বলেন, ‘পুরো সময়টা চোখ বেঁধে রেখে এবং হাতকড়া পরিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আমাকে যখন সেল নামক একটি জায়গায় দেয়া হয়েছে, সে জায়গাটা খুব বেশি হলে একটা কবরের সাইজ হতে পারে।’ আদালতের কাঠগড়ার শিক দেখিয়ে মাহমুদুর রহমান বলেন, সেখানে এ রকম শিকের সাথে আমার এক হাত হাতকড়া বাঁধা এবং বাকিটাও ওই শিকের সাথে বাঁধা অবস্খায় ছিলাম। এভাবে বিকেল ৫টা পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আমাকে সেখান থেকে আবার ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়।
আদালতে তিনি বলেন, যে অত্যাচারের মধ্য দিয়ে আমি ২৪ দিন অতিবাহিত করছি সে অত্যাচারটা করা হচ্ছে আইনকে সামনে রেখে। আইনকে ব্যবহার করে। আইনকে ব্যবহার করে যদি এ ধরনের অত্যাচার একজন নাগরিকের ওপর করা হয়, তাহলে এর ধারাবাহিকতা চলতে থাকবে। এতে রাষ্ট্র কোন অবস্খায় যাবে তা আপনি বিবেচনা করবেন। আদালতকে ধন্যবাদ দিয়ে তিনি তার বক্তব্য শেষ করেন।
এ দিকে পৃথক তিনটি মামলায় ১২ দিনের রিমান্ড শেষে মাহমুদুর রহমানকে গতকাল জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। বিমানবন্দর থানায় দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চার দিনের রিমান্ড শেষে গতকাল দুপুরে তাকে আদালতে হাজির করা হলে নতুন কোনো রিমান্ড আবেদন না থাকায় আদালত তাকে জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন। একই সাথে কারাবিধি অনুযায়ী তার চিকিৎসার ব্যবস্খা ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করারও নির্দেশ দেয়া হয়।
আদালতে মাহমুদুর রহমানের আইনজীবীরা বলেন, রিমান্ডের নামে তার ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। তাকে রক্ষার জন্য মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে সুচিকিৎসা দরকার। আইনজীবীরা আদালতকে আরো বলেন, মাহমুদুর রহমানের বিষয়ে হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিয়েছেন পুলিশ তা মানছে না। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী আদালত আসামিকে অসুস্খ মনে করলে তার সুস্খতার জন্য মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। কিন্তু মাহমুদুর রহমানের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। আইনজীবীরা বলেন, পুলিশ চার দিনের নামে পাঁচ দিন কেন তাকে রিমান্ডে রাখল এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তার কাছে আসামি না রেখে কেন তৃতীয় সংস্খার কাছে হস্তান্তর করল আদালত থেকে তারও ব্যাখ্যা দেয়া উচিত।
মাহমুদুর রহমানকে বেলা ১টা ৫০ মিনিটের সময় আদালতের গারদখানায় নিয়ে আসা হয়। দীর্ঘক্ষণ গারদখানায় রাখার পর তাকে বিমানবন্দর থানায় দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চার দিনের রিমান্ড শেষে বেলা ৩টা ২০ মিনিটে ঢাকার মহানগর হাকিম মোস্তফা শাহরিয়ার খানের আদালতে হাজির করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নতুন করে রিমান্ড না চাওয়ায় মাহমুদুর রহমানকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। একই সাথে কারাবিধি মোতাবেক তার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য জেল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।
আদালত মাহমুদুর রহমানের আইনজীবীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে জেলে পাঠানোর আগে এক ঘন্টা আদালত কক্ষে তার আইনজীবীদের সাথে মামলাসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করার অনুমতি দেন। মাহমুদুর রহমান আইনজীবীদের বলেন, ডিবি অফিস থেকে বের করার সময় তিনি তার মাকে রাস্তায় দেখেছেন। তার চোখে পানি দেখেছেন, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাননি।
এ দিকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমানকে বিমানবন্দর থানায় না রেখে তৃতীয় সংস্খার (পক্ষের) কাছে কেন হস্তান্তর করেছেন সেই বিষয়ে আদালত কোনো আদেশ দেননি।
এর আগে সকালে মাহমুদুর রহমানের আইনজীবীরা ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে পৃথক তিনটি মামলায় জামিনের জন্য আবেদন জানালে অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো: ইসমাঈল হোসেন শুনানি শেষে জামিন নামঞ্জুর করেন।
মাহমুদুর রহমানের পক্ষে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী, ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো: সানাউল্লাহ মিয়া, মো: মাসুদ আহমেদ তালুকদার, মো: খোরশেদ আলম, গোলাম মোস্তফা খান, সালেহ উদ্দিন, ব্যারিস্টার আহসান কবির, মো: মহসিন মিয়া, মোসলেম উদ্দিন জসিম, ওমর ফারুক, খন্দকার দিদারুল ইসলাম, সালেহ উদ্দিন, মো: জাকির হোসেন ভূঁইয়া, মো: তৈমূর আলম খন্দকার, মো: জয়নাল আবেদীন মেজবাহ, মো: তাহেরুল ইসলামসহ প্রায় অর্ধশত আইনজীবী মামলা পরিচালনা করেন।

No comments:

Post a Comment