Sunday 13 June 2010

বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীদের উদ্বেগ : রিমান্ডে মাহমুদুর রহমানকে নির্যাতন : সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের লঙ্ঘন



দৈনিক আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে একের পর এক মামলায় রিমান্ডে নেয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা। তারা বলেন, রিমান্ডের ব্যাপারে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) মামলায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া রায়ে বলা হয়েছে, কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে পাঠানোর আগে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট তার (আসামির) স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে মেডিকেল রিপোর্ট গ্রহণ করবেন। রিমান্ড থেকে ফেরত আসার পর
পুনরায় স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে রিপোর্ট গ্রহণ করবেন। রিমান্ডে আসামির চাহিদা অনুযায়ী চিকিত্সার ব্যবস্থা করতে হবে। আত্মীয়-স্বজনকে দেখা করতে দিতে হবে। একটি মামলায় রিমান্ড শেষ হলে অপর মামলায় রিমান্ডে নেয়ার আগে আসামিকে কারাগারে পাঠিয়ে অবশ্যই মেডিকেল বোর্ডের মাধ্যমে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী তাকে পরবর্তী রিমান্ডে পাঠাতে পারবেন সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট। লাগাতার দুই মামলায় পরপর কাউকে রিমান্ডে পাঠানো যাবে না। মাহমুদুর রহমানের রিমান্ডের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হলে আদালত ব্লাস্ট মামলার এ রায় পুরোপুরি অনুস্মরণ করার জন্য সরকারকে নির্দেশ দেয়। মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের সবাইকে হাইকোর্টের এ আদেশ দেয়ার পরও তারা তা আমলে না নিয়ে আদালত অবমাননা করেছেন বলে মনে করেন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা। তারা বলেন, রিমান্ডের ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতের এ গাইডলাইন সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও তদন্ত কর্মকর্তা মানতে বাধ্য। তারা এটা না মানলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন ক্ষতিগ্রস্ত আসামি পক্ষ।
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, আসামিদের রিমান্ড মঞ্জুর ও জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়াও মাহমুদুর রহমানের বিষয়ে ওইসব নির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত করে সম্প্রতি হাইকোর্ট আরও একটি নির্দেশনা দিয়েছেন। এ নির্দেশনাগুলো মানতে সরকার ও নিম্ন আদালত বাধ্য। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে মাহমুদুর রহমানের রিমান্ডের ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতের ওইসব নির্দেশনা সরকার ও নিম্ন আদালত কেউই মানছে না। উচ্চ আদালতে কনটেম্পট পিটিশন ফাইল করলে দেখা যেত নিম্ন আদালতের বিচারকেরা কোথায় এ সাহস পেয়েছেন। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অগ্রাহ্য করে রিমান্ডের নামে আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর যে নির্যাতন করা হচ্ছে তা কোনো সভ্য সমাজে চলতে পারে না। নিম্ন আদালত ও সরকারের এ আচরণ সংবিধান এবং আইনের শাসনকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। মাহমুদুর রহমানের অবস্থা যাই হোক, আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করার দায়ে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ কর্মকর্তাদের অবশ্যই উচ্চ আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে এবং এর জন্য তাদের জবাবদিহিও করতে হবে। এটা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, ২০০৩ সালে ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় গ্রেফতার করা ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিয়েছিল, মাহমুদুর রহমানসহ অন্য আসামির ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তা মানা হচ্ছে না। তাছাড়া সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারো সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না। নির্যাতন বা নিষ্ঠুর অমানবিক বা অবমাননাকর শাস্তি দেয়া বা তার সাথে এ ধরনের আচরণ করা যাবে না।’ আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান রিমান্ডে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে আদালতে অভিযোগ করেছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখা গেছে, মাহমুদুর রহমান আদালতে অভিযোগ করেছেন, তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। আমরা একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে এ ধরনের আচরণ প্রত্যাশা করি না। তিনি বলেন, কোনো আসামিকে নিরাপত্তা হেফাজতে নেয়ার পর তার জীবনের নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আসামির রিমান্ডের ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছে এটা অনুসরণ করার জন্য আমরা বরাবরই দাবি জানিয়ে আসছি। এ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্যও আমরা সক্রিয়ভাবে কাজ করছি। রাষ্ট্রের হেফাজতে থাকা অবস্থায় একজন আসামির মৌলিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে এর চেয়ে আর দুঃখের কিছু থাকতে পারে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, পত্রপত্রিকায় আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের রিমান্ডকালীন নির্যাতনের যে করুণ বর্ণনা পড়লাম তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এটা আইনের শাসন, সংবিধান ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। একটি সভ্য দেশের জন্য এ ধরনের ঘটনা কলঙ্কজনক। রিমান্ডে নেয়া ও জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারে দেশের সর্বোচ্চ আদালত যে নির্দেশনা দিয়েছে তা অধস্তন আদালত ও সরকার মানতে বাধ্য। বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হওয়ার পর বলা হচ্ছে, নিম্ন আদালতগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করছে। অথচ দেখা যাচ্ছে সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে নিম্ন আদালত স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে যেসব ম্যাজিস্ট্রেট লাগাতারভাবে আসামিদের রিমান্ড মঞ্জুর করেন তারা হয় সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করছেন আর না হয় উচ্চ আদালতের নির্দেশনাকে তারা তোয়াক্কাই করছেন না।
প্রখ্যাত আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, দুনিয়ার সব দেশে পুলিশ একটি মামলার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত ও অনুসন্ধান শেষে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ শেষে আসামি গ্রেফতার করে। আর আমাদের সমাজে এর সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা ঘটছে। কাউকে গ্রেফতার করার পর মামলা হয়। এরপর জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করা হয়। আইনে রিমান্ড বিষয়টি একটি ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা হিসেবে রাখা হয়েছে। বিরোধী মতের ব্যক্তিদের বেলায় এ ব্যতিক্রমী বিশেষ ব্যবস্থাটিই এখন আমাদের দেশে আইনে পরিণত করা হয়েছে। মাহমুদুর রহমানের ব্যাপারে ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় দেয়া নির্দেশনা অমান্য করে শুধু সরকারই আইন ভঙ্গ করেনি, পাশাপাশি নিম্ন আদালতও আইন ভঙ্গ করেছে।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান বলেন, রিমান্ডে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারে হাইকোর্ট একটি নির্দেশনা দেয়। পরবর্তী সময়ে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ এটা বহাল রেখে সরকারকে তা অনুসরণ করার জন্য নির্দেশ দেয়। আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ব্যাপারে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সর্বোচ্চ আদালতের এ নির্দেশনার একটিও অনুসরণ করেনি। এটা আইনের শাসন ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। একইসঙ্গে সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ ও জাতিসংঘ মানবাধিকার সনদের চরম পরিপন্থী। আইনের শাসনের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা থাকলেও একজন ম্যাজিস্ট্রেট উচ্চ আদালতের নির্দেশনা লঙ্ঘন করবেন না। নিরাপত্তা হেফাজতে নেয়ার পর আসামির মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র এ বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন অসীম বলেন, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্লাস্টের দায়ের করা রিটের ব্যাপারে হাইকোর্ট একটি ঐতিহাসিক নির্দেশনা দিয়েছে। যা ৫৫ ডিএলআরে উল্লেখ করা হয়েছে। মাহমুদুর রহমানের রিমান্ডে নেয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করা হলে হাইকোর্ট ব্লাস্টের মামলার পুরো নির্দেশনা অনুসরণ করার জন্য মহানগর হাকিম, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, পুলিশ প্রশাসন, জেলা প্রশাসন, স্বরাষ্ট্র সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ জারি করে। হাইকোর্টের এ আদেশের কপি সর্বত্র দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার ও পুলিশ প্রশাসন সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনার কোনো তোয়াক্কা করছে না। এটা আদালত অবমাননা এবং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি বলেন, মাহমুদুর রহমান নিজেও একজন মানবাধিকার কর্মী। ওয়ান-ইলেভেনের পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার করা হলে এবং এদের অনেককে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম যে কয়েকজন সাহসী ব্যক্তি প্রতিবাদ করেছেন তাদের মধ্যে মাহমুদুর রহমান একজন। ওয়ান-ইলেভেনের জরুরি সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে টিভির টকশোতে বলেছেন এবং পত্রপত্রিকায় অব্যাহতভাবে লিখেছেন। গোটা দেশবাসী এর সাক্ষী। বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ে এসে মাহমুদুর রহমান নিজেই সেই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এটা বড়ই বেদনাদায়ক। এই সরকারকেও মনে রাখা উচিত, তারাই দেশের শেষ সরকার নয়। এরপর আরও সরকার আসবে।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/06/14/35108

No comments:

Post a Comment