Monday 26 July 2010

রিমান্ড ক্রসফায়ারসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ১৪৮ অভিযোগ কমিশনে

স্টাফ রিপোর্টার
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ১৪৮টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে। পুলিশ ও র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এখতিয়ারবহির্ভূত কাজ ও বাড়াবাড়ি নিয়েই বেশিরভাগ অভিযোগ। এর মধ্যে রয়েছে ক্রসফায়ারে হত্যা, পুলিশ-র্যাব কর্তৃক রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, আদালতের ওয়ারেন্ট ছাড়া অবৈধ আটক, বিচারবহির্ভূত হত্যা, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতন, অমানবিক শাস্তি, জীবনের নিরাপত্তা না থাকা ইত্যাদি। মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কিত এসব অভিযোগ সম্পর্কে কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান উদ্বেগ প্রকাশ করে আমার দেশকে বলেন, কোনো সভ্য সমাজে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটা উচিত নয় এবং এটা চলতে দেয়া যায় না। আইন অনুযায়ী মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনাই সমর্থযোগ্য নয়। একটি গণতান্ত্রিক দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উদ্বেগজনক। কোনো নাগরিক অপরাধী হলেও তার বিচারের দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগ কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিতে পারে না। বিচারের দায়িত্ব হচ্ছে বিচার বিভাগের। দায়েরকৃত অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে তদন্ত ও অনুসন্ধান শেষে আইন অনুযায়ী কমিশনের নিজস্ব এখতিয়ার অনুযায়ী অভিযুক্তদের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা ও বিভিন্ন দাতা সংস্থার চাপে ২০০৮ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হয়। সুপ্রিমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরীকে এ কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। প্রয়োজনীয়সংখ্যক লোকবলের অভাবে এ কমিশনের কার্যক্রম বিস্তৃত হয়নি। বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরীর অবসর গ্রহণের পর কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানকে নিয়োগ দেয়া হয়। একইসঙ্গে কমিশনকেও পুনর্গঠন করা হয়।
কমিশন সূত্র জানিয়েছে, এ পর্যন্ত দায়ের করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ১৪৮টি অভিযোগের মধ্যে পুলিশ ও র্যাব কর্তৃক নির্যাতনের অভিযোগ ১৫টি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে অবৈধভাবে আটকের অভিযোগ ৮টি, নিখোঁজ সম্পর্কিত অভিযোগ ৬টি, জীবনের নিরাপত্তা সম্পর্কিত অভিযোগ ২৬টি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক অবস্থায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত অভিযোগ ৬টি, অমানবিক শাস্তি সম্পর্কিত অভিযোগ ৪টি। এছাড়া চাকরি সম্পর্কি অভিযোগ ২১টি, সম্পত্তির অধিকার সম্পর্কিত অভিযোগ রয়েছে ১৬টি, শিশু অধিকার সম্পর্কিত অভিযোগ রয়েছে ৩টি এবং বিবিধ ২৩টি অভিযোগ। খ্রিস্টিয়ান ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের (সিডিএ) নির্বাহী পরিচালক উইলিয়াম নিকলাস গমেজ স্বাক্ষরিত কমিশনে দায়ের করা একটি অভিযোগপত্রে বিচারবহির্ভূত একটি হত্যাকাণ্ডের বিবরণে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজশাহী কলেজের ছাত্র হাফিজুর রহমান শাহীন চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানার চৈতন্যপুর গ্রামে মফিজুল ইসলামের বাড়িতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। বিচারবহির্ভূত এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিচারের দাবি জানানো হয়েছে আবেদনে। আবেদনে আরও বলা হয়েছে, পুলিশের মাধ্যমে এ ঘটনার তদন্ত হলে তদন্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। এ ধরনের অভিযোগ অন্য আবেদনগুলোতেও। আবেদনকারীরা মানবাধিকার কমিশনের কাছে এ ব্যাপারে প্রতিকার চেয়েছেন। তারা র্যাব-পুলিশের হাতে নির্যাতনের বিবরণ নিয়ে বেশকিছু অভিযোগও করেছেন। উল্লেখ্য, মানবাধিকার কমিশনে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে প্রকৃত ঘটনার সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি। ছোটখাটো ঘটনায়ও অনেক রাজনীতিবিদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সমিতি সংবাদ সম্মেলনে পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেছে, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে সারাদেশে ৮৪ জন গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের রিপোর্ট অনুযায়ী গত ৬ মাসে ৬১ জন ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। একই সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় ৯ আসামির মৃত্যু হয়েছে। ২ জন সাংবাদিক নিহত, ৫২ জন আহত ও ৩৫ জন হুমকির শিকার হয়েছেন।
কমিশনের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, পরামর্শকের তৈরি করা অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী এ কমিশনের লোকবল প্রয়োজন ১২৮ জন। অর্থ মন্ত্রণালয় তা কাটছাঁট করে ২৮ জনের নিয়োগ অনুমোদন করেছে। বর্তমানে তদন্ত ও অনুসন্ধান করার মতো কমিশনে লোকবল ৪/৫ জনের বেশি নেই। কাজেই অভিযোগগুলোর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী আমরা কিছু তদন্ত করছি। বাকিগুলো কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিভিন্ন সংস্থা তদন্ত ও অনুসন্ধান করছে। অনুসন্ধান শেষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করা হবে। প্রয়োজনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ দায়ের করা হবে। কমিশনের আইনেই কমিশনকে এ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। এ বিষয়ে কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, বর্তমানে আমাদের লোকবলের সঙ্কট রয়েছে। এছাড়াও বাজেটও একটি বড় বিষয়। আমাদের এগুলোর দিকে তাকালে চলবে না। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন একটি শক্তিশালী আইন। এ আইনে কমিশনকে অনেক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আমরা আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে কমিশনের দায়দায়িত্বও অনেক।
দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ড. মিজানুর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নির্ভর করে মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, রিমান্ডে আসামির ওপর নির্যাতন, আসামিকে গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির না করা ও গুপ্তহত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনাই সমর্থনযোগ্য নয়। এগুলো দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। আমরা জেনেশুনে দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যেতে দিতে পারি না। কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা এসব বিষয় নিয়ে র্যাবের মহাপরিচালক ও পুলিশের ঢাকা মহানগর কমিশনারের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমাদের উদ্বেগের কথা তাদের জানিয়েছি। তিনি বলেন, মামলার প্রয়োজনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কোনো আসামিকে পুলিশ রিমান্ডে নেবে। আইন মেনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আবার তাকে আদালতের কাছে সোপর্দ করবে। বিচারের দায়িত্ব হচ্ছে বিচার বিভাগের। কোনো আসামির বিচারের দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগ কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নয়। বাংলাদেশ নির্যাতনবিরোধী আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে সব নাগরিকের মৌলিক ও মানবাধিকার সংরক্ষণ করবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ হচ্ছে আইনের প্রয়োগ করা। তাদের হাতেই যদি আইনের লঙ্ঘন হয় কিংবা কোনো নাগরিকের অধিকার খর্ব হয়, তাহলে সেটা হবে বড়ই দুর্ভাগ্যজনক। একজন নাগরিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছেন। এটা দেখে তার বিপরীত মতের অন্য নাগরিকের খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা এর শিকার তিনিও একদিন হতে পারেন। কাজেই প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার সংরক্ষণে সবারই সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান আমার দেশকে বলেন, মানবাধিকার কমিশনে যে অভিযোগগুলো এসেছে, তার বাইরেও প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। নারী নির্যাতনের ঘটনা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটকের পর হত্যা, গুপ্তহত্যা, রিমান্ডে নির্যাতনের ঘটনা অনেক বেড়েছে। কোনো গণতান্ত্রিক দেশের জন্য এ ধরনের ঘটনা বিপজ্জনক। এ ধরনের ঘটনা থেকে নাগরিকদের মুক্ত রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র সঠিক দায়িত্ব পালন করলে সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/07/27/36375

No comments:

Post a Comment