Saturday 24 July 2010

১২ দিনেও খোঁজ নেই মুর্তজার : গুম-হত্যার আশঙ্কা বাবা-মার

নাছির উদ্দিন শোয়েব
ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমের পর এবার ১২ দিন ধরে নিখোঁজ শিবির নেতা গোলাম মুর্তজা (৩০)। দু’জনের নিখোঁজ হওয়ার ধরন প্রায় একই। চৌধুরী আলমকে পুলিশ পরিচয়ে এক মাস আগে আটক করা হয় ইন্দিরা রোড থেকে। এখন পর্যন্ত তার খোঁজ নেই। অন্যদিকে মুর্তজাকেও ডিবি পুলিশ হাতকড়া পরিয়ে আটক করে ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর থেকে। তারও কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। মুর্তজা বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে জানে না পরিবার। ডিবি পুলিশ পরিচয়ে গত ১৪ জুলাই আটক করে মাইক্রোবাসে নিয়ে যায় সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা। প্রিয় ছেলের সন্ধান না পেয়ে গুম, হত্যার আশঙ্কায় মুর্তজার বাবা-মার ঘুম নেই। তার ফেরার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে উদ্বিগ্ন পরিবারটি। আত্মীয়স্বজনরা ডিবি, সিআইডি, র্যাব ও ধানমন্ডি থানায় গিয়ে খোঁজ করেছেন। কেউ সন্ধান দিতে পারেনি। কী কারণে তাকে আটক করা হয়েছে? কোথায় রাখা হয়েছে তারা জানতে চান। এ ব্যাপারে আত্মীয়স্বজনরা হাইকোর্টে রিটও করেছেন। আদালত স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশকে এক সপ্তাহের মধ্যে মুর্তজাকে আদালতে হাজির করতে নির্দেশ দেন। কিন্তু এখনও কোনো সংস্থা মুর্তজাকে আটক করার কথা স্বীকার করেনি।
মুর্তজার বাবা-মা ছেলের চিন্তায় ব্যাকুল। মুর্তজা বেঁচে আছে কিনা জানেন না। বেঁচে থাকলে কেন তাকে আদালতে হাজির করা হচ্ছে না। ছেলের খোঁজে বাবা আবদুল লতিফ ও মা গুলনাহার রাজশাহী থেকে ঢাকা এসে বিভিন্ন স্থানে খুঁজছেন। উপায়ন্তর না দেখে গত শুক্রবার সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তারা বলেন, আমাদের ছেলের বিরুদ্ধে কোথাও কোনো অভিযোগ নেই। কোনো থানায় মামলা নেই। তাকে কী কারণে আটক করা হলো? কারা আটক করছে আমরা কিছুই জানি না। সে কোনো অপরাধ করে থাকলে আইনের হাতে তুলে দেয়া হোক।
যেভাবে আটক হয় : গত ১৪ জুলাই সন্ধ্যায় গোলাম মুর্তজা তার বন্ধু আবদুল্লাহ সাবিতকে নিয়ে পুরানা পল্টন থেকে মোটরসাইকেলে কলাবাগান যাচ্ছিল। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় তারা রবীন্দ্র সরোবরে মাগরিবের নামাজ পড়ে। সেখান থেকে মোটরসাইকেলে ওঠার সময় সাদা পোশাকধারী ৬/৭ জন লোক মুর্তজাকে ঘিরে ধরে। তারা টানাহেঁচড়া করে মুর্তজাকে একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাসে তুলে। সাবিত ওই ব্যক্তিদের পরিচয় জানার চেষ্টা করলে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হয়। একপর্যায়ে মাইক্রোবাসটি আবাহনী মাঠের দিকে চলে যায়। প্রত্যক্ষদর্শী সাবিত জানান, মুর্তজাকে তুলে নেয়া মাইক্রোবাসের পেছনে ‘ডিবি’ লেখা ছিল। সে গাড়িটির নম্বর দেখার জন্য মোটরসাইকেলে পিছু নেয়। সাবিত পেছনে ছুটতে থাকলে একপর্যায়ে মাইক্রোবাস থামিয়ে অস্ত্রধারী দু’জন লোক ধাওয়া করে সাবিতকে। সাবিত জানায়, ভয়ে সে আর সামনে এগোয়নি।
থানায় জিডি নেয়নি : মুর্তজার বড় ভাই প্রভাষক আবু কাউছার মোঃ শামসুজ্জামান জানান, ভাইয়ের সন্ধানে পরের দিন তিনি ঢাকায় আসেন। বিকালে ধানমন্ডি থানায় এ বিষয়ে একটি জিডি করতে গেলে ডিউটি অফিসার জিডি নেয়নি। ওসি টেলিফোনে শামসুজ্জামানকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। তিনি বলেন, ওসি হুমকি দিয়ে বলে তোর ভাই কী করে? তুই কী করোস? শালা তোরা সন্ত্রাসী, ক্যাডার। শামসুজ্জামান আরও বলেন, ওসি জিডি গ্রহণ না করে উল্টো তাকে আটক করার হুমকি দেয়। তিনি একঘণ্টা থানার বারান্দায় ঘুরাঘুরি করেন। পরে আটক হওয়ার ভয়ে থানা থেকে চলে আসেন। তিনি বলেন, আমার ভাইকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাকে কারা অপহরণ করে নিল এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ পর্যন্ত দিতে পারলাম না। তিনি বলেন, থানায় এ বিষয়ে কোনো কথাই বলতে দিল না পুলিশ।
সঠিক তথ্য দেয়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী : মুর্তজার আরেক বন্ধু আলমগীর হোসাইন বলেন, ঘটনার পরদিন ১৫ জুলাই তিনি মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ের সামনে মুর্তজাকে খুঁজতে যান। ডিউটি অফিসারের কাছে মুর্তজা নামে কাউকে আটক হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ওই পুলিশ সদস্য ফোনে ডিবির এক কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানান। পরে ডিউটি অফিসার বলেন, আপনি যাকে খুঁজছেন তাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আলমগীর দ্রুত আদালতে যান। সেখানে গিয়ে খোঁজাখুঁজির পর জানতে পারেন এই নামে কাউকে সেদিন আদালতে পাঠানো হয়নি। আলমগীর সন্ধ্যায় আবার ডিবি কার্যালয়ে ফিরে গিয়ে বলেন, আদালতে তো মুর্তজাকে পাঠানো হয়নি। ডিবির ডিউটি অফিসার এবার তাকে জানায়, এ নামে কাউকে আটক করা হয়নি এবং ভেতরে এমন কেউ নেই। হতাশ হয়ে ফিরে আসেন তিনি। আলমগীর বলেন, এরপর উত্তরা র্যাব-১, সিআইডি ও এসবিতে গিয়ে খোঁজা হয়। কিন্তু কেউ সন্ধান দিতে পারেনি।
উদ্বিগ্ন স্বজনরা : মুর্তজার বাবা-মা বলেন, ১২ দিন পার হলেও তাকে আদালতে হাজির করা হয়নি। অথচ নিয়ম অনুযায়ী যে কাউকে গ্রেফতার করা হলে কোর্টে হাজির করা হয়। কিন্তু সেটিও করা হয়নি, যা মানবাধিকারের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। আমরা তার বর্তমান অবস্থা নিয়ে খুবই শঙ্কার মধ্যে আছি। তিনি বলেন, মুর্তজা কোনো অপরাধ করেনি। তার বিরুদ্ধে কোনো মামলাও নেই এবং সাদা পোশাকধারী যারা গ্রেফতার করেছে তারা গ্রেফতারি পরোয়ানা পর্যন্ত দেখায়নি। তাকে রাস্তা থেকে হঠাত্ করে জাপটে ধরে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয় তার সন্ধান চাওয়ার পরও কোনো গোয়েন্দা বাহিনী কিছু জানাতে পারেনি। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে তাকে কী অবস্থায় রাখা হয়েছে, তার সন্ধান দেয়া সাংবিধানিক নাগরিক অধিকার, যা থেকে তাকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। হাইকোর্ট নির্দেশ দেয়ার পরও কোর্টে কিংবা জনসম্মুখে এখনও তাকে হাজির করা হয়নি। তাই অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, গোলাম মুর্তজাকে কোথায় কীভাবে রাখা হয়েছে, তার বর্তমান অবস্থা কী সে সম্পর্কে জানানোর জন্য বা তাকে কোর্টে হাজির করার জন্য। তারা আরও বলেন, মুর্তজা একজন মেধাবী ছাত্র। রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে ২০০৭ সালে মাস্টার্স পাস করে গ্রামের বাড়ি বামনদীঘি, চারঘাট, রাজশাহী থেকে ২০০৮ সালে ঢাকায় এসে এলএলবিতে ভর্তি হয়েছিল। ঢাকায় চাকরি খুঁজছিল। পাশাপাশি শিবিরের কার্যকরী পরিষদের সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিল। সে থাকত ধানমন্ডির ৯১/এ, বশিরউদ্দিন রোড কলাবাগানে।
প্রশাসনকে আদালতের নির্দেশ : নিখোঁজ গোলাম মুর্তজাকে ৭ দিনের মধ্যে আদালতে হাজির করতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। তাকে কেন আইন অনুযায়ী আটক করা হয়নি এর ব্যাখ্যাও আদালতকে জানাতে বলা হয়েছে। গত ১৮ জুলাই মুর্তজার ভাই শামসুজ্জামান হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস রিট দায়ের করলে আদালত এই আদেশ দেয়। একইসঙ্গে স্বরাষ্ট্র সচিব, আইজিপি, ডিএমপি কমিশনার, র্যাব ডিজি, ডিসি ডিবি, ঢাকার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও ঢাকার সিএমএমকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহাব মিঞা ও বিচারপতি কাজী রাজা-উল হক সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ এ আদেশ দেন। গতকাল মুর্তজার মা গুলনাহার বলেন, আদালতের নির্দেশের পরও ৫ দিন পার হলো। এখন পর্যন্ত আমরা কিছু জানি না। এ ব্যাপারে ডিবির ডিসি মনিরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলার জন্য গতকাল সন্ধ্যায় তার মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/07/25/36013

No comments:

Post a Comment