Saturday 3 April 2010

মামলাই সরকারের প্রধান এজেন্ডা



ফকরুল আলম কাঞ্চন ও আলাউদ্দিন আরিফ

মামলা করাই এখন বর্তমান সরকার ও সরকারি দলের লোকজনের প্রধান এজেন্ডা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিরোধী মতের লোকজনকে দমন-নিপীড়নের জন্য মামলাকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন সরকারি দলের নেতাকর্মীরা। ছোটখাটো বিষয়েও একের পর এক মামলা দেয়া হচ্ছে। মামলাবাজিতে নতুন ধারা হিসেবে যুক্ত হয়েছে সিরিজ মামলা। একই বিষয়ে বিভিন্ন এলাকায় এক বা একাধিক ব্যক্তির নামে সিরিজ মামলা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে একই ঘটনায় ২৩টিসহ ৩০টি, জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুকের বিরুদ্ধে ১৯ ও জাতীয় প্রেসক্লাব সভাপতি শওকত মাহমুদের বিরুদ্ধে ৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলার উদ্দেশ্য একটাই—হয়রানি ও বিরোধী মতের লোকজনকে ঘায়েল করা। মামলা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না সাংবাদিক ও পেশাজীবীরাও। শুধু যে নতুন মামলা দেয়া হচ্ছে তা-ই নয়; কয়েক বছরের পুরনো, এমনকি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে এমন মামলাও পুনরুজ্জীবিত করে বিরোধী মতের লোকজনকে হয়রানি করা হচ্ছে। চাঞ্চল্যকর বহু মামলায় বিরোধী দলের একাধিক নেতাকর্মীকে শোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে জামিনের পথ রুদ্ধ করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় নেতাই শুধু নন, বিরোধী দলের গ্রাম-ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মী-সমর্থক থেকে শুরু করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীদের প্রায় সবার নামে একের পর এক মামলা দেয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতাকর্মীর পাশাপাশি সাংবাদিক ও পেশাজীবীদের বিরুদ্ধেও মামলার বহর বেড়েই চলেছে। অপরদিকে বিভিন্ন স্থানে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা হামলা-নির্যাতনের শিকার হলেও তাদের মামলা থানা পুলিশ নিচ্ছে না। বিরোধী মতের লোকজন আদালতে মামলা করলেও রাজনৈতিক বিবেচনায় সেগুলো খারিজ হয়ে যাচ্ছে।
বর্তমান সরকার ১৪ মাসে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে তেমন কোনো সাফল্য দেখাতে না পারলেও মামলাবাজিতে যথেষ্ট দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছে। মামলা দেয়া, মামলা তুলে নেয়া কিংবা পুনঃতদন্তের মাধ্যমে ভিন্নমতের লোকদের মামলায় জড়িয়ে দেয়া, মামলা থেকে নিজেদের লোকদের নাম বাদ দেয়া—এসব নিয়ে কেটেছে সরকারের বিগত ১৪ মাস। অতীতে সরকারি দলের নানা অপকর্ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দায়ের করা ৪ হাজার ১৪৩টি মামলা রাজনৈতিক বিবেচনার কথা বলে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। এখানেও চরম একচোখা নীতি নিয়েছে সরকার। বিরোধী দলের মাত্র দুটি মামলা নামকাওয়াস্তে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ওই দুটি মামলার মধ্যে তারেক রহমানের মামলাটি বাদী আগেই প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। আর অপর মামলাটি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য আইনে দায়ের করা ঠুনকো মামলা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বর্তমান সরকার নতুন মামলা দেয়ার পাশাপাশি ব্যাপকহারে পুরনো মামলা সচল করছে। গত চারদলীয় জোট সরকারের সময় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু’বছরে নিষ্পত্তি হওয়া বহু মামলা আবার সচল করা হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সহিংসতা, সংঘর্ষ, লুটপাট, আলোচিত হত্যাকাণ্ড, অস্ত্র, বিস্ফোরক ও অপহরণ মামলাসহ নিষ্পত্তি হওয়া অনেক মামলা আবার সচল করা হয়েছে। এসব মামলায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের টার্গেট করে আসামি করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া বহুল আলোচিত ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শেখ হাসিনার সমাবেশে বোমা বিস্ফোরণ মামলা, চট্টগ্রামের চাঞ্চল্যকর ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার মামলা, বগুড়ার কাহালুতে এক ট্রাক গুলি উদ্ধার মামলা, রমনা বটমূলে বোমা বিস্ফোরণ মামলা, নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বিস্ফোরণ মামলাসহ বেশ কিছু পুরনো মামলার পুনঃতদন্ত শুরু করেছে এ সরকার। ২১ আগস্ট, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএসএম কিবরিয়া হত্যা মামলাসহ বেশ কয়েকটি পুরনো মামলায় বাবরকে শোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে বারবার রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। লালবাগের সাবেক এমপি নাসিরউদ্দিন আহম্মদ পিন্টুকে বিডিআর বিদ্রোহ মামলা ও নারায়ণগঞ্জে বোমা বিস্ফোরণ মামলায় সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুকে একুশে আগস্ট গ্রেনেড বিস্ফোরণ মামলায় জড়ানো হয়েছে। অবিশ্বাস্য হলেও সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলনকে ঘটনার ৬ বছর পর দায়ের করা মোবাইল ফোন ও ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনতাইয়ের মতো ঠুনকো মামলায় জড়িয়ে জামিন আবেদন নাকচ করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। একইভাবে এহছানুল হক মিলনের এলাকা চাঁদপুরের কচুয়ায় সরকারি দলের নেতাকর্মীদের সাজানো মামলায় জামিন নামঞ্জুর করে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের জেলহাজতে পাঠানো হচ্ছে। কোনো কোনো জেলায় আওয়ামী লীগ কর্মীরাই অপকর্ম, দস্যুতা করে নিজেরা বাদী হয়ে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করছে। এভাবে দেশজুড়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের চরম হয়রানি করা হচ্ছে।
শুধু রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীই নন, বর্তমান সরকার স্বাধীন সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করতে ডজন ডজন মামলা দিয়ে সম্পাদক ও সাংবাদিকদের হয়রানি করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও জ্বালানি উপদেষ্টার ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার বিরুদ্ধে একই ঘটনায় নজিরবিহীনভাবে ২৩টি মামলা দায়ের করা হয়। সব মামলাই দায়ের করেন বর্তমান শাসক দলের নেতারা। একই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২১ জেলায় সরকারদলীয় নেতাদের মামলা দায়েরের ঘটনা এটিই প্রথম। এছাড়াও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দুর্নীতি অনিয়মের সংবাদ প্রকাশের কারণে আমার দেশ সম্পাদক ও প্রতিবেদকদের বিরুদ্ধে আরও এক ডজনের বেশি মামলা হয়েছে।
জাতীয় প্রেসক্লাব সভাপতি শওকত মাহমুদের বিরুদ্ধেও সিরিজ মামলা শুরু হয়েছে। সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করায় ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতারা তার বিরুদ্ধে ঢাকায় দুটি, খুলনা, ঝালকাঠি ও টাঙ্গাইলে একটি করে মোট ৫টি মামলা করেছেন। দেশব্যাপী সাংবাদিকরা এই সিরিজ মামলায় তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা প্রকাশ করেছেন।
এছাড়াও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা করেছে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা। এসব মামলায় বহু সাংবাদিক এখন হুলিয়া নিয়ে ফেরার জীবনযাপন করছেন। সাজানো মামলায় অনেককে জেলেও যেতে হয়েছে।
মামলা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না জাতীয় সংসদের সদস্যরাও। বর্তমান জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুক জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় অবৈধভাবে ভিওআইপি ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনেন। এরপর তিনিও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের রোষানলের শিকার হন। তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক মামলা হতে থাকে। গতকাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে তার বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা নিয়ে মন্তব্য করায় বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগ নেতারা সিরিজ মামলা দায়ের করেন। এসব মামলা গ্রহণ করে আদালত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন।
সরকারের মামলাবাজি থেকে রেহাই পাননি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইর সাবেক দুই প্রধানসহ অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা। নতুন তদন্তের নামে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় তাদের জড়িয়ে দেয়া হয়েছে। গ্রেফতার করে দফায় দফায় রিমান্ডে আনা হয়েছে। লন্ডনে গিয়ে এক সাক্ষাত্কারে ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলও সরকারি মামলা থেকে রেহাই পাননি।
গত অক্টোবরে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপসের ওপর ‘রহস্যজনক’ বোমা হামলা হয়। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় কয়েকশ’ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশীদের মেয়ে মেহনাজ রশীদকে চার মাসের কন্যাসন্তানসহ গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। তাকে শিশুকন্যাসহ চার দফা রিমান্ডে নেয়া হয়। একই মামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব হত্যা মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়া লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমদ আর্টিলারির দুই ছেলে, মেজর (অব.) বজলুল হুদার দুই ভাতিজা ও মেজর (অব.) ডালিমের ভাইকে গ্রেফতার করা হয়। তাদেরও দফায় দফায় রিমান্ডে আনা হয়।
জামায়াত নেতা মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানের একটি বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার সাজানো অভিযোগ তোলা হয়। এই অভিযোগে জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ কয়েক নেতার বিরুদ্ধে সিরিজ মামলা করা হয়। রাজশাহীতে ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হত্যা মামলায় সরকার ঘোষণা দিয়ে চিরুনি অভিযানের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছাত্রশিবির নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করে মামলা দেয়। ছাত্রশিবিরের বহু নেতাকর্মীকে মামলায় জড়িয়ে রিমান্ডে এনে হয়রানি করে। এমনকি চট্টগ্রামে মামলা দায়ের ছাড়াই ছাত্রশিবিরের ৭০ নেতাকর্মীকে রিমান্ডে আনা হয়। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াত নেতাকর্মীদের গণহারে হয়রানি করা হচ্ছে। জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ বেশ কয়েকজন জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে সিরিজ মামলা দেয়া হচ্ছে।
মামলার শিকার ব্যক্তিরা বলছেন, বর্তমান সরকারের ১৪ মাসে দেশে মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর নির্যাতন ও নিষ্পেষণ দুর্বিষহ মাত্রায় পৌঁছে গেছে। বিরোধী দল ও বিরোধী মতকে বিনাশের অপপ্রয়াস হিসেবে গণতন্ত্রের মোড়কে একদলীয় বাকশাল কায়েমের জন্যই সরকারি দলের নেতাকর্মীরা হামলা-মামলার পথ বেছে নিয়েছে। তারা এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেন।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/04/04/25827

No comments:

Post a Comment