Saturday 29 January 2011

বিদেশে কলঙ্কিত হচ্ছে দেশ


আলাউদ্দিন আরিফ

বাংলাদেশের কলঙ্ক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। স্বাধীনতার কিছুদিন পর থেকে শুরু হয় এই হত্যাকাণ্ড। তার আগে প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নকশালপন্থী কমিউনিস্ট তরুণদের দমন করার জন্য নয়াদিল্লি সরকার ১৯৭১ সালে সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ (সিআরপি) দিয়ে অগণিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটায়। সে সময় বাংলাদেশে চলছিল হানাদার পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেশ মুক্ত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে সরকারবিরোধীদের সন্দেহভাজন উগ্রপন্থী বলে খুন করার সরকারি কৌশল চালু করা হয়। ওই সময় কমিউনিস্টদের গোপন সশস্ত্র সংগঠন পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির কয়েকজন ক্যাডার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পরই আটক অবস্থায় নিহত হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন কমরেড আনিস, কমরেড মুজিব, কমরেড বাদল, কমরেড লালগাজীসহ অনেকে।
তত্কালীন সরকারের সেই ধারাবাহিকতায় আজও চলছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিশ্রুতি, আ’লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অগ্রাধিকার, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার কর্মীদের জোরালো প্রতিবাদ সত্ত্বেও কোনোভাবেই এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধ হচ্ছে না। এতে রাষ্ট্র দেশের মানুষের সাংবিধানিক ও নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়ার পাশাপাশি বহির্বিশ্বে দেশের ইমেজও চরমভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
প্রতিদিন সারাদেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। এগুলো সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নয়। মানবাধিকার কর্মী ও বিশিষ্ট আইনজীবীদের মতে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে সংঘটিত হত্যাগুলোই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। পাশাপাশি সরকারি দল বা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের আশ্রিত বিভিন্ন বাহিনীর হাতে যেসব হত্যাকাণ্ড হয় সেগুলোও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিংয়ের আওতায় পড়ে। এর বাইরে প্রতিনিয়ত যেসব হত্যাকাণ্ড হয় সেগুলো ‘ফৌজদারি অপরাধ বা ক্রিমিনাল অফেন্স’। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সূত্রপাত নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কমরেড রইসউদ্দিন আরিফ আমার দেশ-এর সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে বলেন, এ হত্যাকাণ্ড শুরু হয় ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর পরিকল্পনা অনুসারে মুজিব বাহিনীর দুর্বৃত্তরা শত শত দেশপ্রেমিক বিপ্লবীকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল। গুলশানের একটি বাড়িতে পাকিস্তানি জেনারেলদের সঙ্গে বৈঠকে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীলদের নির্মূল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। জি ডব্লিউ চৌধুরী ‘দি লাস্ট ডেজ অব পাকিস্তান’ বইয়ে উল্লেখ রয়েছে ‘মুজিবুর রহমান গর্বসহকারে বলতেন, তিনি পাকিস্তানের বামপন্থীদের নির্মূল করে দিবেন’। যার ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালেও অভিযান, বৈঠক ও আলোচনার কথা বলে বামপন্থী সমর্থক মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপকভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শুরু।
কিছুটা দ্বিমত পোষণ করে অধিকারের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান বলেন, ’৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে যুদ্ধ ছিল। ওই সময়কার হত্যাকাণ্ডগুলো বিচারিক জায়গায় হয়েছে কি হয়নি এটা নতুন বিতর্কের জন্ম দেবে। ওই সময় মুজিবনগর সরকারের হাতে ক্ষমতা ছিল না। ক্ষমতা ছিল পাকিস্তানের হাতে। আমাদের সংবিধানেও ’৭১-এর ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডগুলোকে ইনডেমনিটি দেয়া রয়েছে। তাই ওইসব হত্যাকে বিচারবহির্ভূত বলা যায় না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শুরু ১৯৭২ সাল থেকে। এরপর ’৭৩ সালে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর হাতে অসংখ্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়।
দেশে কত মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার তারও সঠিক কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। ২০০৪ সালে র্যাব গঠনের পর তাদের ক্রসফায়ারে মারা গেছে প্রায় সাতশ’ জন। একই সময়ে পুলিশের ক্রসফায়ারে মারা গেছে এক হাজারের বেশি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বিপ্লবী বামপন্থী ও স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতাকারীদের দমনের নামে বিপুলসংখ্যক মানুষ বিভিন্ন বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে প্রায় প্রতিবছর, প্রতিমাসেই অসংখ্য মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। ১৯৭৩ সালে জাতীয় রক্ষিবাহিনী সৃষ্টি করে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল), পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল), পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতা ও কর্মীদের পাইকারিহারে হত্যা করা হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সর্বাধিক শিকার হয় পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতাকর্মীরা। ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি এ দলের প্রতিষ্ঠাতা ও তত্কালীন প্রধান সিরাজ সিকদার নিহত হন পুলিশি অ্যাকশনে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের ২০ হাজার, মতান্তরে ২৪ হাজার বা ৩০ হাজার নেতাকর্মী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। যদিও অনেকেই বলেন, তারা এসবের পক্ষে প্রমাণ হাজির করতে পারেননি। জাসদের মহানগর কার্যালয় থেকে প্রকাশিত ‘প্রেরণার মুখ’ শীর্ষক একটি সংকলনে ১৯৭২ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার ৩৫০ নেতাকর্মীর একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। জাসদের দাবি ওই তালিকাটি আংশিক। সংকলনটিতে উল্লেখ রয়েছে আওয়ামী লীগের প্রথম আমলে হাজার হাজার জাসদ কর্মীকে হত্যা ও নির্যাতন করা হয়েছে। মুশতাকের শাসনামলেও ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় জাসদ কর্মীরা। সেনা শাসকদের সময়েও জাসদকে দমানোর জন্য প্রকাশ্য ও গোপনে বহু নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে বলে ‘প্রেরণার মুখ’ সংকলনটিতে উল্লেখ রয়েছে।
র্যাব গঠনের পর র্যাব-পুলিশের সংবাদ বিবৃতি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চরমপন্থী হিসেবে পরিচিত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল), পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) (জনযুদ্ধ), পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) (লাল পতাকা), পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি (সিসি), পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি (এমবিআরএম), বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল), শ্রমজীবী মুক্তি আন্দোলন, নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি ও জাসদ গণবাহিনীসহ বিভিন্ন সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক নেতাকর্মীরা বিচারবহির্ভূত হত্যকাণ্ডের (ক্রসফায়ার) শিকার হয়েছে। এছাড়া র্যাব-পুলিশের দেয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তিগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, দাগি আসামি, বহু মামলার আসামি হিসেবে অভিযুক্ত অনেক ব্যক্তি র্যাব ও পুলিশের অভিযানে বিচারবহির্ভূত হত্যকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
২০০৪ সালের ২১ জুন র্যাব গঠন করা হয়। ওই বছর ২৪ জুন র্যাবের প্রথম ক্রসফায়ারে একজন নিহত হয়। এরপর থেকে ক্রসফায়ার নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ২০০৪ সালের ১৮ অক্টোবর সারাদেশে একযোগে অভিযানে নামে র্যাব। ওই বছর ২৬ অক্টোবর র্যাব গঠনের বৈধতা নিয়ে আদালতে মামলা হয়। কিন্তু ওই মামলা আদালতে টেকেনি। এরপর থেকে শুধু র্যাবই নয়, পুলিশ বাহিনীও প্রতিযোগিতা করে ক্রসফায়ার করতে থাকে। দেশ-বিদেশে নানামুখী প্রশ্ন ওঠে এসব হত্যাকাণ্ড নিয়ে। ক্রসফায়ারকে চিহ্নিত করা হয় বিনাবিচারে হত্যাকাণ্ড হিসেবে। দেখা হয় মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হিসেবে। ২০০৪ সালের ২৯ অক্টোবর বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক অনুষ্ঠানে তত্কালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর বলেন, র্যাবের জন্য ইনডেমনিটির প্রয়োজন নেই; কারণ সন্ত্রাসীরা র্যাবকে আক্রমণ করলে, তখন আত্মরক্ষার তাগিদে র্যাবও পাল্টা গুলি করে। এতে করে সৃষ্ট ক্রসফায়ারে সন্ত্রাসীর মৃত্যু ঘটছে। ফলে আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থায় ইনডেমনিটির প্রসঙ্গ আসে না।
ওই সময় আওয়ামী লীগ ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার ছিল। ক্ষমতায় এলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধেরও প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অনেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের ঘোষণা দেন। কিন্তু এরপরও ক্রমাগতভাবেই চলছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড

No comments:

Post a Comment