Saturday 29 January 2011

এক বছরে ঢাকায় ৪৮২৯ রিমান্ড

অলিউল্লাহ নোমান

রিমান্ডের নামে নির্যাতন অব্যাহত আছে। গত এক বছরে শুধু ঢাকা মহানগরে ৪ হাজার ৮২৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। একটি রিমান্ড মঞ্জুরের ক্ষেত্রেও হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা মান্য করা হয়নি। প্রতিটি রিমান্ডের ক্ষেত্রেই অমান্য হয়েছে হাইকোর্ট বিভাগের বিদ্যমান নির্দেশনা। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা লঙ্ঘন করেছেন অধস্তন আদালত।
প্রতিপক্ষ নির্যাতনের অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে রিমান্ড। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের কারণে-অকারণে রিমান্ড মঞ্জুর করা হচ্ছে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। এমনকি আসামি উপস্থিত না করেও রিমান্ড মঞ্জুরের ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার সময় কারাগারে আটক ছিলেন—পরবর্তীতে এমন ঘটনায়ও শ্যোন এরেস্ট দেখিয়ে রিমান্ড চাওয়া হয়েছে বিরোধীদলীয় একাধিক নেতাকে। অধিকারের এক আলোচনা সভায় বিশিষ্ট নাগরিকরা রিমান্ডকে রাষ্ট্রীয় বর্বরতা হিসেবেও উল্লেখ করেছেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু ঢাকার সিএমএম কোর্টে ৩৬৫ দিনে ৪ হাজার ৮২৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে। গড়ে প্রতিদিন ১৩ জনকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে শুধু ঢাকা মহানগরে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রিমান্ড মঞ্জুরের ঘটনা ঘটেছে কোতোয়ালি, বংশাল, লালবাগ, চকবাজার ও কামরাঙ্গিরচর থানার অধীনে। এসব থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এক বছরে ৬৩৮ জনকে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। সবচেয়ে বেশি রিমান্ডের ঘটনা ঘটেছে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা মহানগরে ৪৩৩ জনকে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে জুলাই মাস। জুলাই মাসে ৪৩০ জনকে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে ঢাকা মহানগরে। গেল ডিসেম্বরে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে ৪১২ জনকে।
ঢাকার সিএমএম কোর্টে অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত বছরের জানুয়ারিতে ৪০৫, ফেব্রুয়ারিতে ৪৩৩, মার্চে ৪১২, এপ্রিলে ৩৮৭, মে মাসে ৩৯১, জুনে ৪১০, জুলাইতে ৪৩০, আগস্টে ৪০৭, সেপ্টেম্বরে ৩৬৭, অক্টোবরে ৩৭৪, নভেম্বরে ৪০১ এবং ডিসেম্বরে ৪১২ জনকে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যাদের একাধিকবার রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।
সিএমএম কোর্টের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এসব রিমান্ড মঞ্জুরের আগে কখনও কারও মেডিকেল রিপোর্ট নেয়া হয়নি এবং রিমান্ড ফেরতের পরও মেডিকেল রিপোর্ট দেখা হয়নি। অথচ হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনায় রয়েছে
রিমান্ড মঞ্জুরের আগে মেডিকেল রিপোর্ট পরীক্ষা করতে হবে। রিমান্ড থেকে ফেরতের সময়ও মেডিকেল রিপোর্ট দেখতে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রতি নির্দেশনা রয়েছে হাইকোর্ট বিভাগের। এছাড়া রিমান্ড মঞ্জুরের আগে মামলা ভালো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নির্দেশনাও রয়েছে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে। হাইকোর্ট বিভাগের এই নির্দেশনার কোনো তোয়াক্কাই করে না ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। পুলিশ রিমান্ড চাইলেই হলো, মঞ্জুর হয় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, রিমান্ডের নামে পুলিশ ও আইনজীবীদের বাণিজ্য চলে আদালতে। যে কোনো মামলায় কাউকে ধরলেই রিমান্ডে নেয়া হবে—এই ভয় দেখিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে মোটা অংকের টাকা দাবি করা হয়। আবার আসামির রিমান্ড না চাইলেও আইনজীবীদের পক্ষ থেকে আত্মীয়-স্বজনকে বলা হয় রিমান্ড চাওয়া হয়েছে, বাতিল করতে অনেক টাকা লাগবে। নিরূপায় হয়ে তখন রিমান্ড থেকে বাঁচার জন্য আত্মীয়-স্বজনরা ধার-দেনা করে পুলিশ ও আইনজীবীর চাহিদা অনুযায়ী টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য হন। রিমান্ড মঞ্জুরের পর নির্যাতন করা হবে না—এই নিশ্চয়তা দিয়েও মোটা অংকের টাকা দাবি করে পুলিশ। নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে তখন মরিয়া হয়ে ওঠেন আত্মীয়-স্বজন ও আসামি নিজে। পুলিশ যা চায় তখন তাই দিতে বাধ্য হন আত্মীয়রা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সরকারি দলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রিমান্ডে নেয়ার ঘটনা সম্প্রতি ঘটছে প্রতিনিয়ত। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে রিমান্ড হচ্ছে সরকারি নির্যাতনের বড় হাতিয়ার। বাকস্বাধীনতাকে চাপা দিতে সাংবাদিক ও সম্পাদককে রিমান্ডে নিতেও কসুর করেনি সরকার। বর্তমান সরকারের দুর্নীতি, অনিয়ম নিয়ে কথা বলায় দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার নামে দেয়া হয় একের পর এক মামলা। বিভিন্ন মামলায় দেখানো হয় শ্যোন এরেস্ট। দিনের পর দিন নেয়া হয় রিমান্ডে। একেবারে ঠুনকো অজুহাতে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। তাকে গ্রেফতারের সময় আমার দেশ কার্যালয়ে কারা ছিলেন তাদের নাম ঠিকানা জানার জন্য রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়েছিল তাকে। অথচ আমার দেশ কার্যালয়ে যখন পুলিশ হানা দেয় তখন সাংবাদিকদের ওপরই উল্টা নির্যাতন চালানো হয়েছিল। আহত হয়েছিল অনেক সাংবাদিক। তারপরও সম্পাদকের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। মাহমুদুর রহমানকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করা হয়েছে ক্যান্টনমেন্ট থানায়। নির্যাতনে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। এ নির্যাতনের কাহিনী আদালতের সামনে উপস্থাপন করার পরও তাকে আবার রিমান্ডে দিয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।
সাবেক ছাত্রনেত্রী, ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্র নেতৃত্বদানকারী মোশরেফা মিশুকে বর্তমান শাসক দলের সময় বার বার রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। গার্মেন্ট কারখানায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে ইন্দনের অভিযোগে সম্প্রতি তাকে নিজের বাসা থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে রিমান্ড চায়। তার ওপর চালানো হয় নির্যাতন। নির্যাতনের কারণে বর্তমানে তিনি পুলিশ হেফাজতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রিজন সেলে চিকিত্সাধীন আছেন।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে ২৯ জুন হরতালের সময় গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাকে শ্যোন এরেস্ট দেখানো হয় মগবাজারে একটি গাড়ি পোড়ানো মামলায়। একই সঙ্গে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানানো হয় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। এ মামলায় সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মোবিন চৌধুরীকেও শ্যোন এরেস্ট দেখিয়ে রিমান্ড চাওয়া হয়। দু’জনেরই রিমান্ড মঞ্জুর করেন ম্যাজিস্ট্রেট।
ঢাকা মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির রফিকুল ইসলাম খানকে গত ৪ ডিসেম্বর মুক্তি পাওয়ার সময় কারাগার গেট থেকে আটক করে সাদা পোশাকধারী ডিবি পুলিশ। একদিন পর তাকে শ্যোন এরেস্ট দেখিয়ে আদালতে হাজির করা হয় শাহবাগ থানার একটি মামলায়। এ মামলাটিও দায়ের করা হয় ২৯ জুন হরতালকে কেন্দ্র করে। এ মামলায় তাকে রিমান্ড চাওয়া হলে মঞ্জুর করা হয়। অথচ এ মামলার কোনো পর্যায়ে তার নাম কোথায়ও উল্লেখ নেই। পরবর্তী সময়ে পল্টন থানার একটি মামলায় তাকে আবারও রিমান্ড চাওয়া হয়। এ মামলায় তিনি আগে থেকেই জামিনে ছিলেন। এতে তাকে রিমান্ড না দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে আরেকটি মামলায় শ্যোন এরেস্ট দেখানো হলে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। সর্বশেষ টানা ১৮ দিন রিমান্ডে থাকার পর তাকে মতিঝিল থানার একটি মামলায় আদালতে হাজির করা হয়। এ মামলা দায়ের ও ঘটনার সময় তিনি কারাগারে ছিলেন। কারাগারে থাকাকালীন ঘটনাকে কেন্দ্র করে দায়ের করা মামলায় শ্যোন এরেস্ট দেখিয়ে রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করা হলে আইনজীবীরা বিষয়টি স্পষ্ট করেন। আদালত তখন রিমান্ড না দিয়ে জেল হাজতে পাঠান।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতারের পর আদালতে নেয়া হলে তিনি নির্যাতনের কাহিনী তুলে ধরেন। গ্রেফতারের পরপরই তার ওপর এ নির্যাতন চালানো হয়েছিল। তখনও তার নাক দিয়ে ঝরছিল রক্ত। আদালত এ অবস্থায়ই তাকে আবার রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ সময় ঢাকা মহানগর ছাত্রনেতা ইসহাক সরকারকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সামনেই গ্রেফতার করে পুলিশ। একদিন পর আদালতে উপস্থাপন না করেই তাকে রিমান্ড চাওয়া হয়। ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে এমন একজনকে হত্যার অভিযোগ এনে তার রিমান্ড চাওয়া হয়েছিল। আইন অনুযায়ী রিমান্ডের আবেদন আসামির উপস্থিতিতে শুনানি করার বিধান রয়েছে। ইসহাক সরকারকে আদালতের সামনে উপস্থাপন না করে ম্যাজিস্ট্রেটের খাস কামরা থেকে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।
পুলিশ যাকে ইচ্ছা তাকেই বিভিন্ন মামলায় শ্যোন এরেস্ট দেখাচ্ছে এবং রিমান্ড চাইছে। আদালতও ঢালাওভাবে রিমান্ড মঞ্জুর করে চলেছেন। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় রিমান্ড আবেদন একটি নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ ১৬৭ ধারা সংশোধন করতে সরকারের প্রতি নির্দেশনা জারি করেন। একই সঙ্গে ওই ধারাটি সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত রিমান্ডে নিতে হলে কী কী পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে এবং রিমান্ড মঞ্জুরের পর কীভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট একটি গাইডলাইনও দেন আদালত। এ রায়টি আপিল বিভাগে এখনও বহাল আছে। এতে গাইড লাইন দিয়ে বলা হয় রিমান্ড আবেদনের সঙ্গে মেডিকেল রিপোর্ট জমা দিতে হবে। রিমান্ড থেকে ফেরতের সময়ও আরেকটি মেডিকেল রিপোর্ট দিতে হবে। রিমান্ড মঞ্জুরের সময় ম্যাজিস্ট্রেটকে মামলার সঙ্গে আসামির সংশ্লিষ্টতা ও রিমান্ড মঞ্জুরের প্রয়োজনীয়তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্দেশনা রয়েছে এতে। রিমান্ডে নিয়ে একটি স্বচ্ছ কাচের ঘরে আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলা হয়েছে হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনায়, যাতে আসামির আইনজীবী বা আত্মীয়রা দেখতে পারেন জিজ্ঞাসাবাদে কোনো নির্যাতন হচ্ছে কিনা। প্রয়োজন অনুযায়ী চাহিদা মতো রিমান্ডে ডাক্তারি পরীক্ষার নির্দেশনাও রয়েছে রায়ে। কিন্তু এসব নির্দেশনার একটিও পালন করা হয়নি গত বছরের ৪ হাজার ৮২৯টি রিমান্ডে।

No comments:

Post a Comment