Saturday 22 January 2011

অধিকারের মানবাধিকার প্রতিবেদন অনুষ্ঠানে বক্তারা : রিমান্ড এখন চরম রাষ্ট্রীয় বর্বরতা


স্টাফ রিপোর্টার

বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন উপস্থাপন উপলক্ষে অধিকার আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন বাংলাদেশ এখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে রূপ নিয়েছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে খুন ও গুমের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। রিমান্ড এখন একটি চরম রাষ্ট্রীয় বর্বরতা। এরকম দীর্ঘ রিমান্ড ও রিমান্ডে নির্যাতনের ঘটনা অন্য কোন দেশে নেই। দেশ স্বাধীন করা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের প্রতিবাদে। কিন্তু সেই নির্যাতন থেকে মানুষ রেহাই পাচ্ছে না।
গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ ২০১০ সালের মানবাধিকার প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, বর্তমান সরকার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা পূরণে তারা ব্যর্থ হয়েছে। অধিকারের দাবি অনুযায়ী প্রতি ৩ দিনে গড়ে ১ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
অধিকারের সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খান এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। এ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ড. সিআর আবরার। অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন অধিকারের উপদেষ্টা বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক ও চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার, বিশিষ্ট সাংবাদিক কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি, বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সিএসএসডি মহাসচিব মাহফুজ উল্লাহ, ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না, সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া এমপি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ড. ফয়জুল হাকিম লালা, বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রাজেকুজ্জামান রতন, পাক্ষিক চিন্তা’র সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মুস্তাইন জহির প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরী এ প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য অধিকারকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, সমস্যা হচ্ছে আমরা মানবাধিকার ইস্যুটিকেও রাজনীতিকীকরণ করেছি। আমাদের উচিত মানবাধিকার বিষয়ে রাজনৈতিক ইচ্ছাকে মজবুত করা এবং দলমত নির্বিশেষে এ ব্যাপারে ঐকমত্য তৈরি করা। মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, অধিকারের এই রিপোর্ট মোটামুটি ভালো। এ অবস্থা বরাবরই চলে আসছে। যতদিন দেখলাম একইরকম অবস্থা দেখছি। আমাদের দেশের শাসক শ্রেণী ক্ষমতায় থাকার জন্য এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। তবে আমরা ভবিষ্যতে ভালো দেখতে চাই।
ফরহাদ মজহার দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, আমরা যদি আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিষয়টি দেখি, তাহলে দেখা যাবে সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে বিচার বিভাগ এখতিয়ার দিয়ে শাস্তি দিয়েছে। যা তারা দিতে পারে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে রূপ নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এখন গুমের ঘটনা বাড়ছে। এটি একটি ভয়াবহ বিষয়। এ থেকে বোঝা যায় রাষ্ট্র কীভাবে জনগণ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তবুও রাষ্ট্রের প্রশ্নে, অধিকারের প্রশ্নে, মানবাধিকারের প্রশ্নে আমরা একমত হতে পারছি না। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বিষয়ে তিনি বলেন, র্যাবের বিরুদ্ধে যদি আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ আনতে পারি, তাহলে বিএসএফের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ করতে পারব না কেন? বিএসএফ যা করছে, তা চরম বর্বরতা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, আমাদের রাষ্ট্র চরম নিপীড়নমূলক। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা একইরকম অবস্থা দেখে আসছি। রিমান্ড একটি চরম রাষ্ট্রীয় বর্বরতা। মানবজাতির ইতিহাসে এত দীর্ঘদিন রিমান্ড আমাদের দেশের মতো অন্য কোনো দেশে হয়নি। অন্য কোনো দেশে রিমান্ডে নিয়ে কাউকে উলঙ্গ করে অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন করা হয়নি। তিনি বলেন, সুপ্রিমকোর্টের কাজ হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু তারা তা করেন না। তারা অনেক সময় রাজনৈতিক বক্তব্য দেন। এর প্রতিবাদ করলে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। অন্যদিকে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার চেয়ে সরকারের রাজনৈতিক স্লোগান দিনবদল নিয়ে বেশি ব্যস্ত।
মাহফুজ উল্লাহ বলেন, অনেকেই এই সরকারের সমালোচনা ও বিরোধিতা করতে রাজি নন। কারণ এটা করলে তাদেরকে স্বাধীনতাবিরোধী বলা হয় এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রতিহত করার প্রয়াস হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তিনি বলেন, একটি নতজানু সরকারের কাছ থেকে সীমান্তে হত্যার বিচারের প্রতিবাদ আশা করা যায় না।
অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকারের দ্বিতীয় বছরে অর্থাত্ বিগত ২০১০ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ১২৭ জন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে প্রাণ হারিয়েছেন ১১০ জন, রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ২২০ জন, গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৭৪ জন। ধর্ষিত হয়েছেন ৫৫৬ নারী ও শিশু। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১১৯ নারী এবং ৯৩ শিশু। আর যৌতুকের কারণে সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ২৪৩ জন। অন্যদিকে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষাবাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে নিহত হয়েছেন ৭৪ জন এবং ওই বাহিনীর হাতে অপহৃত হয়েছেন ৪৩ বাংলাদেশী। আর অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে গতবছর ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর হামলায় নিহত হয়েছেন ২ জন এবং আহত হয়েছেন ২৪৪ জন। মন্দির ভাংচুর হয়েছে ২৩টি। এসময় জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর হামলায় ৬ জন নিহত এবং ১৪০ জন আহত হয়েছেন।
আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের শাসনামলে ফিরে এসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুম। গতবছর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুম হয়েছেন ১৬ জন।
অধিকারের বিপোর্টে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিষয়ে বলা হয়, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে সরকার বরাবর প্রতিশ্রুতি দিলেও তা ২০১০ সালজুড়েই অব্যাহত ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইন ভঙ্গ করে সন্দেহভাজন ব্যক্তি, বিপ্লবী বামপন্থী এবং নিরীহ ব্যক্তিদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করেছে। ২০১০ সালে ১২৭ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এই হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হয়েছে র্যাব ও পুলিশ অথবা র্যাব-পুলিশের যৌথবাহিনী দ্বারা। অধিকারে সংগৃহীত তথ্যানুযায়ী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার ১২৭ জনের মধ্যে তথাকথিত ক্রসফায়ারে ১০১ জন, নির্যাতনে ২২ জন, গুলিতে ২ জন এবং ২ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে র্যাবের হাতে ৬৮ জন, পুলিশের হাতে ৪৩ জন, র্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযানে ৯ জন, র্যাব-কোস্টগার্ডের যৌথ অভিযানে ৩ জন, র্যাব-পুলিশ-কোস্টগার্ডের যৌথ অভিযানে ৩ জন এবং বিডিআরের হাতে একজন নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জেল এবং বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে মৃত্যু প্রসঙ্গে বলা হয়—গতবছর ১১০ জন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে মারা গেছেন। এদের মধ্যে ৬ জন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে থাকাকালে ক্রসফায়ারে, ২২ জন নির্যাতনে এবং ১ জন গুলিতে মারা গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ওই সময় ৬০ জন জেল হেফাজতে ‘অসুস্থতাজনিত’ কারণে মারা গেছেন। আর ২ জন কোর্ট হেফাজতে, ২ জন থানায় এবং ১ জন র্যাব হেফাজতে মারা গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বিডিআর বিদ্রোহের অভিযোগে আটক ১৫ বিডিআর সদস্য জেল এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে মারা গেছেন।
রিপোর্টে গুম বিষয়ে বলা হয়, গতবছর ১৬ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুম হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ভিকটিমের পরিবারগুলোর অভিযোগ, উল্লিখিত ব্যক্তিদের সাদা পোশাকধারী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা র্যাব এবং পুলিশের পরিচয় দিয়ে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
বিএসএফের হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রসঙ্গে বলা হয়, গতবছর ভারতীয় সীমান্ত রক্ষাবাহিনী (বিএসএফ) ৭৪ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। এদের মধ্যে ২৪ জনকে নির্যাতন এবং ৫০ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ সময়ে বিএসএফের হাতে আহত হয়েছেন ৭২ জন। এর মধ্যে ৩২ জন নির্যাতিত এবং ৪০ জন গুলিবিদ্ধ। একই সময় ৪৩ বাংলাদেশী বিএসএফের হাতে অপহৃত হয়েছেন।

No comments:

Post a Comment