Wednesday 23 February 2011

ইমেজ সঙ্কটে দেশ



বশীর আহমেদ

মানবাধিকার লঙ্ঘন, মিডিয়া দলন, শিশু নির্যাতন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেপরোয়া আচরণসহ সরকারের বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা এখন মলিন। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন সবচেয়ে বেশি ইমেজ সঙ্কটে আছে বাংলাদেশ।
নেতিবাচক খবর হিসেবেই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পাচ্ছে। এমনকি ব্যর্থরাষ্ট্র হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ যে ৩৭টি রাষ্ট্রের তালিকা তৈরি হয়েছে, সেই তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম।
দ্য গার্ডিয়ান, নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসিসহ বিশ্বের প্রধান গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের কলুষিত চিত্র ফুটে উঠেছে। শিশুদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে পুলিশ, করুণভাবে তাকিয়ে আছেন নির্যাতিত সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জোর করে বন্ধ করে দিচ্ছে ছবি প্রদর্শনী, বড় বড় হরফে লেখা বাংলাদেশ সরকার ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছে—এমন অসংখ্য নেতিবাচক খবর বাংলাদেশকে নিয়ে। এছাড়া দারিদ্র্য বৃদ্ধি এবং গার্মেন্ট শ্রমিকদের করুণ কাহিনীর খবর তো আছেই।
মানবাধিকার সংগঠন জাস্টিস কনসার্নের ওয়েবসাইটটি ভিজিট করলে প্রথমেই চোখে পড়বে বাংলাদেশের একটি ছবি। এক শিশুকে নির্মমভাবে পেটাচ্ছে পুলিশ। ছবির ওপরে শিরোনামে লেখা হয়েছে পোশাক শ্রমিকদের হরতালে যোগ দেয়ায় বাংলাদেশের পুলিশ শিশুদের পেটাচ্ছে। ওয়েবসাইটটির দ্বিতীয় খবরটিও বাংলাদেশের। দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিমর্ষ ছবিসহ শিরোনাম করা হয়েছে—অমানবিক নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশের এক সম্পাদক। এ ব্যাপারে বিবিসি মনিটরিং বিভাগ থেকে নেয়া তথ্য তুলে ধরে ওয়েবসাইটে বলা হয়, পুলিশ হেফাজতে নির্মম নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষার জন্য পদক্ষেপ নিতে আদালতের কাছে আবেদন জানান মাহমুদুর রহমান। তিন দিনের রিমান্ড শেষে যখন তাকে আদালতে হাজির করা হয় তখন তিনি দাঁড়াতে পারছিলেন না। আদালত তাকে বসার অনুমতি দেন। মাহমুদুর রহমান আদালতে প্রশ্ন তোলেন, যেখানে মানবাধিকার সমুন্নত রাখার কথা বলা হচ্ছে সেখানে একজন ব্যক্তির ওপর এমন নির্মম নির্যাতন করা যায় কিনা।
প্রসঙ্গত আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার ও নির্যাতনের খবর ব্যাপকভাবে প্রচার হয় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। সৃষ্টি হয় তীব্র প্রতিক্রিয়া। এ ইস্যুতেই সবচেয়ে বেশি ক্ষুণ্ন হয়েছে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা। এ প্রসঙ্গে দ্য গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার দেশটির তৃতীয় সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছে। পুলিশ পত্রিকার প্রধান কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে। মাহমুদুর রহমান শেখ হাসিনা সরকারের দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় এবং নিবন্ধ লিখেছিলেন।হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ফ্রন্ট লাইন, সিপিজে, রিপোর্টার্স উইথআউট বর্ডারসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতারে বাংলাদেশ সরকারের কঠোর সমালোচনা করা হয়।
বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে এখন বাংলাদেশ। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে সরকার।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক শুনানিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি অঙ্গীকার করেছিলেন, বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যা মেনে নেবে না সরকার। এতসব প্রতিশ্রুতির পরও অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশে এখন অনেক বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটছে। বিশ্ব মিডিয়ায় এটা এখন অন্যতম আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে র্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে র্যাবকে বাংলাদেশের ডেথ স্কোয়াড হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের এই বাহিনী বিনা বিচারে এক হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে।
র্যাবের এ বিচারবহির্ভূত হত্যা বা ক্রসফায়ার নিয়ে গত বছর বিখ্যাত আলোকচিত্রী শহিদুল আলম একটি ছবি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন ঢাকায়। সরকারের নির্দেশে সেই প্রদর্শনী ভণ্ডুল করে দেয় পুলিশ। ওই ঘটনা ফলাও করে প্রচার করে নিউইয়র্ক টাইমস। প্রদর্শনী বন্ধে পুলিশি আক্রমণের ৭টি ছবি প্রকাশ করে নিউইয়র্ক টাইমস।
গত বছর বাংলাদেশে ফেসবুক বন্ধের ঘটনায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক বক্তব্যের জন্য ফেসবুক বন্ধ করে দেয় সরকার। বিবিসিসহ বিশ্ব মিডিয়ায় গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হয় ওই খবর। খবরে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়, যেভাবে পাকিস্তানে ফেসবুক বন্ধ করা হয়েছিল ঠিক একইভাবে বাংলাদেশে ফেসবুক বন্ধ করেছে সরকার। বেতন নিয়ে গার্মেন্ট শ্রমিকদের অসন্তোষ, সহিংসতা, শ্রমিকদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের খবর হারহামেশাই প্রকাশ হচ্ছে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়।
বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের করুণচিত্র অব্যাহতভাবে স্থান পাচ্ছে মিডিয়ায়। বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের যে চিত্র ইউনিসেফের রিপোর্টে এসেছে তা ভয়াবহ। বাংলাদেশে গ্রামের চেয়ে শহরের গরিব মানুষের অবস্থা বেশি খারাপ বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে। এটা একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। বাংলাদেশ সম্পর্কে এ খবর ফলাও করে প্রচার করেছে এলার্টনেট নামের ওয়েবসাইট। ব্যাংকক থেকে পাঠানো এলার্টনেটের কনটেম্লট পার্টনার আইআরআইএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, শহরের চেয়ে গ্রামের গরিব হওয়াই ভালো। বাংলাদেশে ইউনিসেফের স্টাডিতে এটাই এখন সত্য। আগে ধারণা ছিল শহরের চেয়ে গ্রামের দরিদ্র মানুষের অবস্থা বেশি খারাপ। এ ধারণা পাল্টে গেছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে শহরের বস্তিতে বসবাসকারী দরিদ্র মানুষের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার গ্রামের চেয়ে দ্বিগুণ। শহরের তুলনায় গ্রামের দরিদ্র শিশুদের শিক্ষার হার অন্তত তিনগুণ বেশি।
এভাবেই নেতিবাচক খবর হিসেবেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বারবার আলোচিত হচ্ছে বাংলাদেশ। আর দিন দিন কলুষিত হচ্ছে দেশের ভাবমর্যাদা। এখানেই শেষ নয়, ইউকিপিডিয়া ২০১০ সালের ব্যর্থ রাষ্ট্রের যে ইনডেক্স প্রকাশ করেছে সেখানে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে ব্যর্থরাষ্ট্র হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ৩৭টি দেশকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ তালিকার এক নম্বরে রয়েছে সোমালিয়া। ২৪তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ

No comments:

Post a Comment