Friday 9 December 2011

হায়রে মানবাধিকার!!

শওকত মাহমুদ

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর দীর্ঘ মুসাবিদায় ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর বিশ্বজনীন মানবাধিকার সনদ গৃহীত হয়। ৬৩ বছর পেরিয়ে গেল। আজ বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে দাঁড়িয়ে, কোনো এক ধরনের জীবনবৃত্তে দৃষ্টি না ফেলেই হতাশা এবং আতঙ্কে শুধু এটুকুই বলতে পারি, দু’টি ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার পরেও বাংলাদেশের মানুষ মানবাধিকারের সিকিভাগ স্বাদ পায়নি। এ মুহূর্তের বাংলাদেশ যে প্রায় মানবাধিকার-শূন্য এবং সে জন্য এক বদ্ধজলাশয়ে আমরা একে অপরকে ফাঁকি দিয়ে গিলে-খেয়ে-বাড়তে-চাওয়া ব্যাঙাচিদের মতো টিকে থাকার সংগ্রামে প্রবৃত্ত। সে কথা তো আন্তর্জাতিক সমাজই বলছে। শাসকদের ফ্যাসিবাদী আচরণের জন্য অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো শীর্ষ মানবাধিকার-সুরক্ষা সংগঠন এই আন্তর্জাতিক আহ্বান জানিয়েছে, যেন বাংলাদেশের কাছে কেউ অস্ত্র বিক্রি না করে। তাদের মতে, এসব অস্ত্র বাংলাদেশের মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘনে ব্যবহৃত হয়। ক্রসফায়ার, গুপ্ত হত্যা, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, সীমান্তে নির্বিচারে বাংলাদেশী হত্যা, আদালতে ন্যায্য বিচারের সঙ্কট, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় আঘাত, বিরোধী দল ও মতের প্রতি হিংসাত্মক আচরণ, সাংবাদিক-নির্যাতন মানবাধিকারের সব সূচকই সংখ্যা ও আতঙ্কের মাত্রায় রেকর্ডভঙ্গকারী।
ব্রিটেনের সাবেক লর্ড চিফ জাস্টিস এবং বিচারপতি হিসেবে অসম্ভব স্বাধীন এবং মানবাধিকার-বান্ধব বলে পরিচিত ছিলেন এবং ঐতিহাসিক রায়ে সরকারকে নাস্তানাবুদ করেছেন, সেই লর্ড বিংহামের (দি রুল অব ল খ্যাত) একটি কথা উদ্ধৃত না করে পারছি না। তিনি বলছেন, ‘A state which savagely represses or persecutes sections of its people cannot in my view he regarded as observing the rule of law, even if the transport of the persecuted minority to the concentration camp or the compulsory exposure of female children on the mountainside is the subject of detailed laws duly enacted and scrupulously observed.” [P-67, The Rule of Law). অর্থাত্ জনগণের নানা অংশকে যদি একটি রাষ্ট্র নির্মমভাবে নির্যাতিত ও খুন করে, তাকে আইনের শাসন মান্যকারী সরকার বলা যাবে না। যদি সংসদে সব নিয়ম মেনে এমন আইন পাস করা হয়, যার দায়ে কাউকে নিগ্রহের শিকার বানিয়ে পূতিগন্ধময় আতঙ্কজনক বন্দি শিবিরে পাঠানো হয় অথবা বাচ্চা মেয়েদের পাহাড়ে থাকতে বাধ্য করা হয়, তাহলেও সে রাষ্ট্র মানবাধিকারের পরিপন্থী। অর্থটা পরিষ্কার। আইন যদি মানবাধিকার খর্বকারী হয়, তা হলেও চলবে না। আইনকে আইনের মতো হতে হবে। বিখ্যাত দার্শনিক স্পিনোয়ার স্মরণীয় উক্তি হচ্ছে খধ িরং ঃযব সধঃযবসধঃরপং ড়ভ ভত্ববফড়স (আইন হচ্ছে স্বাধিকারের অংক). নািস জার্মানিতে বলা হতো, আইন হচ্ছে জার্মান জাতির অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ এবং জার্মান জাতির অভিপ্রায় হিটলারের মধ্যে বিলীন। ধরা যাক, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক দুটি আইনের কথা। পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন আইনটি পাস হলো স্রেফ প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে। ওই সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির গরিষ্ঠরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। যেসব গুণী ব্যক্তি, আইনবিদ ও সুশীল ব্যক্তি সংসদে মত দিতে গিয়েছিলেন, তারাও এর পক্ষে। কিন্তু সব নাকচ করলেন প্রধানমন্ত্রী। আর বিরোধী দল বা জনগণের মতামত নেয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বাদই দিলাম। যেই সংবিধান সংশোধনীর প্রতি জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন নেই, সংসদে পাস হয়ে গেলেই তা মেনে নিতে হবে? আবার ওই সংশোধনীর সমালোচনা করলেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ—এও কি এই সভ্য দুনিয়ায় সম্ভব? ঢাকা শহরকে ভাগ করার আরেকটি আইন পাস হলো মাত্র চার মিনিটে। প্রধানমন্ত্রী এবং হাতে গোনা কয়েক মন্ত্রী ও এমপি এর পক্ষে কথা বলেন। বাকিরা কেউ না। এই আইনও মানতে হবে? আজকের দুনিয়ায় বিশেষ করে ১৯৫০ সালে গৃহীত ইউরোপীয় মানবাধিকার সনদের রক্ষক ইউরোপীয় ইউনিয়ন অব্যাহতভাবে বলে আসছে যে গণতন্ত্রায়ণ, আইনের শাসন, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান এবং সুশাসন পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
মানবাধিকারের ধারণা : দুঃখজনক হলেও সত্য, মানবাধিকার সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্পষ্ট নয়। এর উত্পত্তি এবং বিকাশ সম্পর্কেও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নই। মৌলিক অধিকারকে মানবাধিকার মনে করি অথচ মানবাধিকারের ব্যাপ্তি মৌলিক অধিকারের চেয়ে বেশি। যেমন—ভোটের অধিকার নাগরিকের মৌলিক অধিকার। কিন্তু একজন ব্যক্তির চিকিত্সা লাভের অধিকার মানবাধিকার, তিনি যে দেশের হাসপাতালেই যান না কেন। মানবাধিকারের ধারণাটি অনেক খোলামুখ। নতুন নতুন বিষয়সংক্রান্ত অধিকার, এমনকি জন্তুরও অধিকার, ক্রমে ক্রমে মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
মানবাধিকার বিষয়ে আমাদের ভাবনার দিগন্ত সময়ে সময়ে দুই দিকেই প্রসারিত হয়েছে—কাদের জন্য অধিকার এবং কোন্ কোন্ বিষয়ে অধিকার। দুই দিন আগে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সমকামীদের অধিকারকে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, তাদের বৈদেশিক সাহায্যনির্ভর করবে সাহায্যগ্রহীতার সমকামী নাগরিকদের অধিকার-অনধিকারের ওপর। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থানের সঙ্গে অনেকেই সহমত নন।
মূলত ন্যাচারাল ল’ বা স্বাভাবিক আইনের ধারণা থেকে মানবাধিকারের যাত্রা শুরু। ফরাসিদের অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই বিখ্যাত এনসাইক্লোপিডিয়াতে ‘ন্যাচারাল ল’ প্রবন্ধটির রচয়িতা ছিলেন অগ্রণী দার্শনিক দেনিস দিদেরো। তাঁর ব্যাখ্যা মতে, স্বাভাবিক অধিকার হচ্ছে এক ধরনের সর্বজনীন অভিপ্রায়, যা অন্তরালে থেকে আমাদের সামাজিক ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত প্রভৃতির নির্দেশনা দিচ্ছে সতত। এই সর্বজনীকের নিরিখে আমাদের শিখে নিতে হবে আমি কীভাবে মানুষের মতো হয়ে উঠব, কীভাবে আমি নাগরিক হিসেবে, পিতা হিসেবে, মাতা হিসেবে, ঠিকঠাকভাবে আমার যাপন সাব্যস্ত করব। আমার স্বাভাবিক অধিকারে প্রতিবেশীর বিরূপ হওয়ার অথবা প্রতিবেশীর স্বাভাবিক অধিকারে আমারও বিপন্ন হওয়ার কিছু নেই। এই যে অন্য কারও ক্ষতি না হওয়া, এটাই স্বাভাবিক অধিকারের সীমা। দিদেরোর উপসংহার হচ্ছে এমন : ১. শুধু ব্যক্তি অভিপ্রায়ের দিকে মগ্ন ব্যক্তি মানবজাতির শত্রু, ২. প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যই সর্বজনীন অভিপ্রায় এমন এক মানদণ্ড, যার সাহায্যে অন্যের কাছে আমার প্রত্যাশা এবং আমার কাছে অন্যের আকাঙ্ক্ষা সহজে নির্ণয় করা যায়, ৩. ওই অভিপ্রায়ের আলোকে নিজের সমাজের কাছে একজন ব্যক্তির দায় যেমন নির্ধারণ করা যায়, তেমনি অন্য সমাজের কাছেও নিজের সমাজের দায় নির্ণয় করা সম্ভব, ৪. সর্বজনীন অভিপ্রায়কে মেনে চলাই সব সমাজের মূল ভিত্তি এবং ৫. আইন সবার জন্য, কোনো একক ব্যক্তির জন্য নয়। এর পর সামাজিক চুক্তির চিন্তা প্রসঙ্গে জন লকের মতো দার্শনিকরা মানবাধিকার নিয়ে ভেবেছিলেন। তিনিও স্বাভাবিক আইনের ভিত্তিতে স্বাভাবিক অধিকারের ধারণা দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। আত্মরক্ষার অধিকার, সম্পত্তি রক্ষার অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার অধিকার—এই তিন অধিকার ছিল লকের চিন্তায় মূল অধিকার। এই চিন্তাধারায় জ্যঁ জ্যাক রুশো মানবাধিকারকে সর্বজনীন করার ক্ষেত্রে আরও এগিয়ে যান। অধিকারসংক্রান্ত চিন্তার বিবর্তনে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধও এক জরুরি পর্ব। ১৭৭৬ সালে টমাস জেফারসনের ঘোষণা মোতাবেক সব মানুষের সমানাধিকারের কথাটা খুব স্পষ্ট করে উচ্চারিত হয়েছিল। তাতে বলা হয়, ‘এই সত্য স্বতঃপ্রকাশ বলে আমরা গ্রহণ করি যে, সব মানুষই সৃষ্টিলগ্নে সমান এবং সৃষ্টিকর্তার হাত থেকেই তারা কিছু অপরিত্যাজ্য অধিকার অর্জন করেছে, এসব অধিকারের মধ্যে আছে জীবন, স্বাধীনতা ও সুখের সন্ধানের অধিকার।’ সম্পত্তির অধিকারের জায়গায় এলো সুখের সন্ধানের অধিকার। ১৭৮৯ সালে ফরাসিদের মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকারের ঘোষণা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে বিরাট অগ্রগতি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিভীষিকার পর ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বিশ্বজনীন মানবাধিকার সনদ গৃহীত হলো।
তথ্য অধিকার : তথ্যের অধিকার কি মানবাধিকারের পর্যায়ে পড়ে কি না, শুরুতে এ নিয়ে অস্পষ্টতা থাকলেও ফরাসি ঘোষণার পর সে বিভ্রান্তি কেটে যায়। এই ঘোষণার ১৭টি অনুচ্ছেদের ১১-তে বলা হয়েছে, ‘চিন্তা ও মতামতের অবাধ প্রবাহ মানুষের এক মহার্ঘ অধিকার। অতএব প্রত্যেক নাগরিকের বলা, লেখা ও ছাপানোর অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে, তবে প্রচলিত আইন অনুসারে এ স্বাধীনতার অপব্যবহারের জন্য দায়িত্বও সেই নাগরিককে বহন করতে হবে।’ জাতিসংঘ সনদের ১৯ ধারায় আরও একটু এগিয়ে বলা হলো : ‘প্রত্যেকেরই মতামতের ও প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার আছে; এই অধিকারের মধ্যে আছে বিনা বাধায় মতামত পোষণ করা এবং কোনো সীমানা নিরপেক্ষভাবে যেকোনো মাধ্যমে তথ্য ও চিন্তা সন্ধান করা, পাওয়া এবং অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়ার অধিকার।’ বাংলাদেশের সব সরকার অল্পবিস্তর এ সনদ এর আগে লঙ্ঘন করেছে। অথচ এসব সনদে স্বাক্ষরকারী প্রতিটি দেশের আইনের সমান শক্তি সনদেরও। বর্তমান মহাজোট সরকার সরাসরি মিডিয়া বন্ধ করে দিয়ে, অসাংবিধানিক নীতিমালা চাপিয়ে, সাংবাদিকদের মেরে ও জেলে পুরে, টিভির টকশো ও সরকারি বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ করে যে মাত্রায় মিডিয়া ও লেখক সমাজকে আপদমস্তকে চেপে ধরেছে, তার নিষ্কৃতি কোথায়? মানবাধিকার ও সেই প্রসঙ্গে তথ্যের অধিকার এ জন্যই জরুরি যে আমরা নির্বাচিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর ভেবেছিলাম এসব দিয়ে আমরা এক সমৃদ্ধ মানবিক জীবনযাপনের অনুকূল সমাজ ব্যবস্থায় যাব। উন্নয়ন হবে অধিকারভিত্তিক বা ভত্ববফড়স ড়ত্রবহঃবফ. হয়েছে উল্টোটা। তথ্য বা অতথ্যের আড়ালে জ্ঞানই হারিয়ে যাচ্ছে।
মানবাধিকারের স্তম্ভ : সাংবাদিক হিসেবে শুধু আত্ম-অধিকারের ঘাটতি নিয়ে কথা বলা শোভনীয় নয়। বড়দাগে মানবাধিকারের স্তম্ভ হচ্ছে— জীবনের প্রতি অধিকার, নির্যাতন নিষিদ্ধকরণ, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নিরাপত্তার অধিকার, ন্যায্য বিচার প্রাপ্তির অধিকার, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও পারিবারিক জীবনযাপনের অধিকার, চিন্তা, বিবেক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সমাবেশ ও সংঘের অধিকার।
ক্রসফায়ার বা গুপ্ত হত্যায় যে প্রায়ই লোক মরছে, তাদের কি জীবনের প্রতি অধিকার ছিল না? সেসবের তদন্ত করতে গিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক নারী কর্মকর্তাকে এই আমলে বিপদে পড়তে হয়েছিল। হাইকোর্টের যে বেঞ্চ ক্রসফায়ারের জন্য রুলনিশি জারি করেছিল, সেই বেঞ্চকেই ভেঙে দেয়া হয়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি উপরোল্লিখিত প্রতিটি বিষয়ের জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সনদগুলোয় অনুস্বাক্ষর দিয়েছে। সেসব মানতে রাষ্ট্র বাধ্য। অথচ আমরা এ নিয়ে সোচ্চার হই না। জাতিসংঘের দ্বারস্থ হই না। ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতে এক ফিলিপিনি-ইউরোপীয় নাগরিক ফিলিপিনো সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছিল। সে সময় ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্টের হল্যান্ড সফরের কথা। আদালত ওই অতিথির জন্য আপস সমন জারি করে বললেন, ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট বেড়াতে এলে যেন আদালতে ঘুরে যান। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট তার ইউরোপ সফরই বাতিল করে দিলেন। বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে আন্তর্জাতিকমনা ব্যক্তিত্ব বা মেধা আছে, যারা একটু সোচ্ছার হলেই বাংলাদেশ-পরিচালকদের ঘাম ছুটে যেতে পারে। মানবাধিকারের স্তম্ভগুলো যে প্রতিদিন এই দেশে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, সে ব্যাপারে আমরা সোচ্চার হই না। শুধু বিরোধী দলের দায়িত্ব এসব নিয়ে বলা। কারণ তারা ভুক্তভোগী। তাদের কথা শুনতে অভিজন সমাজের বেসুরো লাগে। আবার বিরোধী দলটি কে, সে প্রশ্নও ওঠে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকলে দেশীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো কী চিত্কারই না করে। গণগ্রেফতারের ঘটনায় সুশীল সমাজ ‘রে রে’ করে তেড়ে ওঠে। কিন্তু বিএনপির ক্ষেত্রে তার সিকি ভাগও ঘটে না। বিএনপি নেতা তারেক রহমানের প্রতি নিরাপত্তাবাহিনীর অমানুষিক নির্যাতনকে আজকের প্রধানমন্ত্রী সংসদীয় বক্তৃতায় হাস্যরসের সঙ্গে উল্লেখ করেন। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে তাঁর বাড়ির মামলায় আপিল বিভাগে ন্যায্য বিচার (একতরফা শুনানির জন্য পাননি, সে সম্পর্কে সুশীল সমাজ বা মানবাধিকারপ্রেমীরা মুখ খোলেন না), যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলেই আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। সুপ্রিমকোর্টের অ্যাডভোকেট এম ইউ আহমেদকে বিনা অভিযোগে ডিবি পুলিশ ধরে নিয়ে চার ঘণ্টার নির্যাতনে মেরে ফেলেছে বলে যে অভিযোগটি জাতির সামনে উলঙ্গ হয়েছিল, সে সম্পর্কে তো কোনো বিচারপতি সুয়োমোটো রুল জারি করে ডিবি পুলিশকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়নি। অথচ হাসপাতালে মৃত্যু বা চিকিত্সাহীনতার জন্য কোম্পানির পরিচালকমণ্ডলীকে আদালতে তলব করা হয়েছে। মানবাধিকার কমিশনকেও দেখিনি স্বইচ্ছায় তদন্ত করতে। আসলে রাজনীতির পক্ষ-বিপক্ষের তাড়না থেকে মানবাধিকারের প্রয়োগ দানবাধিকারকেই বোঝায়। তাই আসুন সবাই মিলে রাষ্ট্রের নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই, মানুষের অধিকারকে সম্মান করতে শিখি এবং এই ভাবনায় জেগে উঠি যে কোনো নিরপরাধ মানুষ যেন শাস্তি না পায়। বিনা বিচারে কেউ যেন কারাভোগ না করে, আদালতগুলো সাহসের সঙ্গে নিরপেক্ষ বিচার করুক, ভিন্নমতের জন্য কারও শাস্তি না হয়, প্রত্যেক মানুষ, সংঘ বা দল সমাবেশের অধিকার ভোগ করে, মিডিয়া সরকারের আঁচড়মুক্ত থাকবে এবং কোনো আইন যেন মানুষের অধিকারকে সামান্যতমও খর্ব করতে না পারে। আমি আশাবাদী যে বাংলাদেশ একদিন মানবিক রাষ্ট্র হবেই, তবে মহাজোট সরকার আমাদের অনেকখানি পিছিয়ে নিয়ে গেছে। ইউরোপের আলোক বর্ষের পেছনে আমরা এখনও। তাদের অতীতটা আমাদের বর্তমান। অথচ গণতান্ত্রিকতায় এক সময় আমরা ছিলাম এগিয়ে। ইউরোপের মানুষ যখন পাথরের বাসনে চাকু দিয়ে গোশত কেটে খেত, তখন আমরা কলাপাতা ছেড়ে বাসনে খাওয়া শিখে ফেলেছি।

No comments:

Post a Comment