Monday 31 October 2011

বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এখন সঙ্কুচিত



বশীর আহমেদ
বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এখন সঙ্কুচিত। গণমাধ্যম কর্মীরা সরকার ও রাজনৈতিক দলের আক্রমণ এবং বিচার বিভাগের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। দুর্নীতির খবর প্রকাশ করায় আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ এবং এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ নানা ধরনের নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে দেশটিতে।
এফআইডিএইচ-ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের ২০১১ সালের বার্ষিক রিপোর্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির এই ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। রিপোর্টে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে রিমান্ডের নামে চলছে নির্যাতন। শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে।
মানুষের মতপ্রকাশ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কে রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এখন আরও সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে খবর প্রকাশের জন্য সাংবাদিকদের চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। রাজনৈতিক দল ও এর নেতাকর্মীদের আক্রমণ এবং বিচার বিভাগের হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকরা। অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলোর ওপর।
আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ এবং এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে তার ওপর চালানো নির্যাতনের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে রিপোর্টে।
রিপোর্টে বলা হয়, সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা এবং দুর্নীতির বিষয় প্রকাশ করায় আমার দেশ পত্রিকা পুলিশ এবং বিচার বিভাগের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। সরকারের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের দুর্নীতির খবর প্রকাশ এবং বিডিআর বিদ্রোহের একটি গোপন তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের কারণে পুলিশ আমার দেশ কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয় এবং এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আটক করে। মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনে পুলিশ। মাহমুদুর রহমানসহ পত্রিকার ডেপুটি এডিটর সৈয়দ আবদাল আহমদসহ মোট পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগ এনে আরও একটি মামলা করে পুলিশ। এরপর মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র এবং জঙ্গিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ এনে একের পর এক মামলা দেয়া হয়। ১২ দিনের জন্য রিমান্ডে নেয়া হয় মাহমুদুর রহমানকে। এ সময় তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। তাকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন চালানো হয় এবং নির্যাতনের ফলে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
রিপোর্টে বলা হয়, ২০১০ সালের ১০ জুন রাতে ৫-৬ অজ্ঞাত ব্যক্তি তার সেলে ঢুকে নির্মম নির্যাতন চালায়।
রিপোর্টে বলা হয়, পুলিশ এখন পর্যন্ত মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাপারে কোনো তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে পারেনি। বিচার বিভাগের হয়রানির প্রসঙ্গ তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়, একই দিনে ঢাকা ও গোপালগঞ্জে হাজিরার দিন ছিল মাহমুদুর রহমানের। একই সময়ে দুই জেলায় হাজিরা দেয়া সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতিতে মাহমুদুর রহমানের আইনজীবী গোপালগঞ্জের আদালতে হাজিরার দিন পুনর্নির্ধারণের আবেদন জানান। আদালত ওই আবেদন গ্রহণ না করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
রিপোর্টে আরও বলা হয়, অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের জালিয়াতির সমালোচনা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় সুপ্রিমকোর্ট আদালত অবমাননার অভিযোগে মাহমুদুর রহমানকে সর্বোচ্চ শাস্তি ৬ মাসের কারাদণ্ড এবং ১ লাখ টাকা জরিমানা করেন। এছাড়া রিপোর্টার অলিউল্লাহ নোমানকে এক মাসের কারাদণ্ড দেন। আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ এবং সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানিয়ে বিরোধী দল সংসদ থেকে ওয়াকআউট করে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়, পুলিশ এবং র্যাব সদস্যরা ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছেন। তাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। অব্যাহত রয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। ২০১০ সালে ১২৭ জনকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জনকে। এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অধিকাংশই ঘটিয়েছেন র্যাব সদস্যরা। প্রতি তিনদিনে ১টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে বাংলাদেশে।
কোনো ধরনের জবাবদিহি করতে হবে না—এই নিশ্চয়তা পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলেছেন বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
সীমান্তে মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রসঙ্গে রিপোর্টে বলা হয়, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। তারা নিরীহ বাংলাদেশীদের হত্যা এবং অপহরণ করছে, চালাচ্ছে নির্মম নির্যাতন। বিএসএফের এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে উদ্বেগের বিষয়টি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দিল্লি সফরের সময়ে উত্থাপন করেননি বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে।
শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশও বাংলাদেশে এখন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মন্তব্য করে রিপোর্টে বলা হয়, পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন নিশ্চিত করার দাবিতে সভা-সমাবেশ পর্যন্ত ভণ্ডুল করে দিয়েছে পুলিশ। নির্যাতন এবং গ্রেফতার করা হয়েছে পোশাক শ্রমিকদের।
এছাড়া মানবাধিকার কর্মী এবং এনজিও সংগঠকরাও নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হচ্ছেন বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে। মানবাধিকারসংক্রান্ত অনেক প্রকল্প অনুমোদন করছে না সরকার। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প আটকে দিয়েছে সরকার।

No comments:

Post a Comment