Friday, 5 August 2011

যুদ্ধাপরাধবিষয়ক আন্তর্জাতিক সেমিনার : ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দেয়ার দাবি আইনজীবীদের



স্টাফ রিপোর্টার
যুদ্ধাপরাধ বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন আইনজীবীরা। একইসঙ্গে তারা অবিলম্বে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমকে তার পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর দাবি জানিয়ে বলেন, তিনি ওই পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত গণতদন্ত কমিশন এবং গণআদালতের সঙ্গে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে গতকাল আন্তর্জাতিক একটি সেমিনারে আইনজীবীরা এ দাবি জানান। সেমিনারে অংশ নেয়া দেশের খ্যাতিমান আইনজীবীরা বলেন, এ ট্রাইব্যুনাল তার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে এবং এ ধরনের বিচারের
যোগ্যতা ও দক্ষতা তাদের নেই। এ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পাওয়ার কোনো আশা নেই। যুদ্ধাপরাধ বিচার নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিরোধী ইসলামী দল ও নেতৃবৃন্দকে ধ্বংস করাই তাদের লক্ষ্য।
নাগরিক ফোরামের উদ্যোগে রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত এ সেমিনারে বক্তারা বলেন, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান পদে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের থাকার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। কারণ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বর্তমানে যাদের আটক করা হয়েছে তিনি আগে থেকেই তাদের একই অভিযোগে অভিযুক্ত করে তাদের বিচার দাবি করেছেন। একজন বিচারপতি হিসেবে তার এ পদ গ্রহণ করাও ন্যায়সঙ্গত হয়নি।
‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশে ফৌজদারি বিচার পদ্ধতি : আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কি রাবার স্ট্যাম্প’ র্শীষক সেমিনারে আইনজীবীরা বলেন, বিচার নয় বরং বিএনপির কয়েকজন নেতাকে হেয় করা এবং জামায়াতে ইসলামীকে ধ্বংস করার জন্যই যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে। এটি এখন আর এদেশের কারও কোনো বক্তব্য নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন এ কথা বলতে শুরু করেছে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত বিশ্বখ্যাত সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন দি ইকোনমিস্টের চলতি সংখ্যার একটি প্রতিবেদনে একথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেনের সভাপতিত্বে সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার এমপি, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, বিশিষ্ট সাংবাদিক সাদেক খান, সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া, সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ ফাহিমা নাসরিন মুন্নি, সুপ্রিমকোর্টের আইনীজীবী ব্যারিস্টার বেলায়েত হোসেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হোমাম কাদের চৌধুরী প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য যুদ্ধাপরাধবিষয়ক ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান সেমিনারে যোগ দেয়ার জন্য বিমানবন্দরে এসে পৌঁছলে তাকে সেখান থেকে ফেরত পাঠানো হয় সরকারের নির্দেশে। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন নাগরিক ফোরামের সভাপতি আবদুল্লাহেল মাসুদ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ যুদ্ধাপরাধ আদালত বিষয়ে চার দফা দাবি উপস্থাপন করে বলেন, বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান পদে থাকার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। তিনি ১৯৯২ সালের গণআদালতের রায় বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছিলেন। এছাড়া ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত গণতদন্ত কমিশনের সেক্রেটারিয়েট সদস্য ছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উদাহরণ তুলে ধরে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, কোনো বিচারের সঙ্গে আগেই যাদের দূরতম কোনো সম্পর্ক থাকে তারা কোনোদিন সেই একই বিচারের ক্ষেত্রে বিচারকের আসনে বসতে পারেন না। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, বিচারপতি নিজামুল হক কি তার পূর্ব সম্পৃক্ততার বিষয় অস্বীকার করতে পারবেন?
বন্দি ব্যক্তিদের জামিন দিতে হবে দাবি করে মওদুদ আহমদ বলেন, অনেকদিন তাদের আটকে রেখেছেন আপনারা। এক বছর পার হয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো চার্জশিট দিতে পারেননি। এ থেকে বোঝা যায়, রাজনৈতিক কারণে ট্রাইব্যুনাল তাদের বিষয়ে বিলম্ব করছে এবং আটক রেখেছে। এজাতীয় বিচারে কোনোদিন স্বচ্ছতা আশা করা যায় না। ট্রাইব্যুনাল যোগ্যতা হারিয়েছে উল্লেখ করে মওদুদ আহমদ বলেন, এ ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দিতে হবে এবং নতুন করে গঠন করতে হবে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালের এ ধরনের বিচারের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তারা অদক্ষ। কোনোদিন এ জাতীয় বিচার তারা করেননি। এ ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধ বিচার করার ক্ষমতা রাখে না। ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি, আইনজীবী এবং তদন্তকারী অনেকেই ঘাতক-দালাল, গণআদালত এবং গণতদন্ত কমিশনের সঙ্গে জড়িত। তারা নিরপেক্ষ নন। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধ আইনকে সুরক্ষার জন্য যে সংবিধান সংশোধন করা হয় তা ছিল সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই এ বিচার প্রক্রিয়াও সাংবিধানিক নয়।
এ চার দফা দাবি জানিয়ে মওদুদ আহমদ বলেন, যদি আপনারা এগুলো না মানেন তাহলে প্রমাণ হবে আপনারা রাজনৈতিকভাবে বিরোধী দলকে ধ্বংস করার জন্য এ বিচার করছেন। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জন্য তার পরিবার বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আপনারা সে অনুমতি দেননি। একইভাবে জামায়াত নেতাদেরও এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, আপনাদের নিরপেক্ষ বিচারের সাহস নেই। টবি ক্যাডম্যান নামে একজন ব্রিটিশ আইনজীবী আজকের এ সমাবেশে যোগ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাকে বিমানবন্দরে আটকে দেয়া হয়েছে। এ থেকেও বোঝা যায়, আপনারা নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ নন। গোটা জাতি এবং বিশ্ব বুঝে গেছে, এ বিচার হচ্ছে রাজনৈতিক কারণে বিরোধী দল দমনের জন্য। ইকোনমিস্টের সর্বশেষ প্রতিবেদনেও সে কথা বলা আছে।
ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, অভিযোগকারী কখনও বিচারের আসনে বসতে পারেন না। যিনি একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন তিনি কি করে তার বিচার করবেন? এ বিচার তো ন্যায়বিচার হতে পারে না।
খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের ধ্বংস করার জন্য এ বিচার চলছে। বিচারের নামে কেউ কেউ এদের ফাঁসিতে ঝোলানোরও স্বপ্ন দেখছে। তিনি বলেন, আগে আসল যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার বিচার করুন, তারপর দেশীয়দের বিচারের কথা চিন্তা করা যাবে। মাহবুব হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ আজকের এই সেমিনার সম্পর্কে বলবে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করার জন্য এ সমাবেশ করা হয়েছে। কিন্তু এখন আর সে সুযোগ নেই। কারণ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম গণতদন্ত কমিশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং তা সবাই জেনে গেছে।
ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, জামায়াত এবং বিএনপির নেতারাসহ এদেশীয় লোকজন যখন যুদ্ধাপরাধের বিচারকে রাজনৈতিক বিচার হিসেবে আখ্যায়িত করে আসছে তখন সরকার বলেছে, আমরা যুদ্ধাপরাধ বিচারকে বানচাল করার জন্য এসব নাকি বলছি। কিন্তু এ বিচার যে সত্যিই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য করা হচ্ছে, তার পক্ষে শক্ত প্রমাণ রয়েছে। আজ সব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, এ বিচার রাজনৈতিক, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা উদ্দেশ্য নয়। গত ২১ জুন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত যে সাতজনকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে তার মধ্যে ৫ জনই জামায়াতে ইসলামীর নেতা এবং দু’জন বিএনপি নেতা। এতে এ ধারণার জন্ম নিচ্ছে যে, শুধু বিরোধী নেতাদের টার্গেট করার জন্যই এ বিচারের আয়োজন চলছে।
লন্ডন থেকে প্রকাশিত বিশ্বখ্যাত সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘দি ইকোনমিস্ট’-এর চলতি সংখ্যার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা নয়, বরং বিরোধী ইসলামিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে ধ্বংস করার জন্যই ট্রাইব্যুনালকে ব্যবহার করা হচ্ছে।’
ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, আপনাদের সাহস থাকলে ট্রাইব্যুনালে বিদেশি বিচারপতি, আইনজীবী এবং তদন্তকারী নিয়োগ দেন। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, আপনাদের সে সাহস নেই, কারণ আপনারা মিথ্যার ওপর বিচার করছেন।
ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক আবারও চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন, সাহস থাকলে সংবিধানের প্রথম সংশোধনী বাতিল করুণ। কিন্তু আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি আপনারা তা করতে পারবেন না। বিচারের সিআরপিসি প্রয়োগ না করার কারণে তিনি একে আনসিভিলাইজড হিসেবে উল্লেখ করেন।
ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, যেখানেই এ জাতীয় বিচার হয় সেখানেই আগে থেকেই অপরাধীদের তালিকা করা থাকে। কিন্তু আজ ৪০ বছর পরও নতুন করে লোকজনকে তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। এক বছর আটক রাখার পরও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারে না। অথচ ৪০ বছর আগে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক একটি উদাহরণ টেনে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এ জাতীয় অভিযোগে একজনকে গ্রেফতারের এক দিন পরই চার্জশিট প্রদান করা হয়।
সাদেক খান ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন তুলে ধরে বলেন, এ বিচার করা হচ্ছে জামায়াত ধংস করার জন্য। আজ দেশে যা কিছুই করা হচ্ছে তার মূল উদ্দেশ্য হলো দেশকে অকার্যকর করা। অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের ঘাতক-দালাল এবং গণতদন্ত কমিশনের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে বলেন, আপনার এ পদ গ্রহণ করা উচিত হয়নি। আপনি পদত্যাগ করে আবার হাইকোর্টে ফিরে আসুন।
তিনি বলেন, যিনি আইনের শাসনে বিশ্বাস করে না তিনি এখন আইনমন্ত্রী। তারা গোলাম আযমকে ফাঁসির রায় দিয়েছিলেন। তিনি এখন ঘাতক-দালালের নিজামুল হক নাসিমকে বানিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান, যাতে গোলাম আযম ছাড়া বাকি যারা ছিলেন তাদেরও ফাঁসির ব্যবস্থা করতে পারেন।
ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল বলেন, হাইকোর্টের বিচারপতি শুধু হাইকোর্টের বিচার করবেন, এটি সংবিধানে বলা আছে। কিন্তু হাইকোর্টের বিচারপতিকে করা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান। আবার নিজামুল হক নাসিম এটিএম ফজলে কবিরের চেয়ে ২৯ জন পরে ছিলেন সিরিয়ালের দিক দিয়ে, কিন্তু তার অধীনে এখন জুনিয়র হিসেবে কাজ করছেন ফজলে কবির। তিনি বলেন, এ ট্রাইব্যুনাল গুয়ান্তানামো কারাগারের চেয়েও খারাপ। সানাউল হক বলেন, আন্তর্জাতিক আদালতের ‘আও’ নেই এখানে। বিচারের নামে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করাই এর আসল কাজ

No comments:

Post a Comment