নাছির উদ্দিন শোয়েব
পুলিশের নৃশংসতা বেড়েই চলছে। ভেঙে পড়েছে চেইন অব কমান্ড। পুলিশ বাহিনীতে অনেকটা বেসামাল অবস্থা। রাজনৈতিক দল দলনেই পুলিশের অতিউত্সাহ একের পর এক বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। এতে এই বাহিনী এখন ব্যাপকভাবে সমালোচিত। নিরপরাধ মানুষের ওপর পুলিশি নির্যাতনে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে মানবাধিকার। সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত কয়েকটি ঘটনায় পুলিশের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ও বেআইনি কর্মকাণ্ডে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও হতাশ ও ক্ষুব্ধ। পুলিশের নির্যাতনের কয়েকটি ঘটনায় আদালত রুল দিতে বাধ্য হয়ছেন। ঘটনা তদন্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গঠন করা হয়েছে কমিটি। সাসপেন্ডসহ বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পুলিশের প্রতি আস্থা না থাকায় নির্যাতনের কয়েকটি ঘটনায় বিচারবিভাগীয় তদন্ত শুরু করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরে দফায় দফায় বৈঠক করেও কাজ হচ্ছে না। কোনো অবস্থাতেই শৃঙ্খলা ফিরে আসছে না পুলিশ বাহিনীতে।
সুপ্রিমকোর্টের খ্যাতনামা আইনজীবী অ্যাডভোকেট এমইউ আহমেদকে আটক এবং নির্যাতনের কারণে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আব্দুল কাদেরকে আটকের পর ডাকাত সাজিয়ে নির্যাতন, নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জে ডাকাত সন্দেহে কিশোর মিলনকে পিটিয়ে হত্যা, আমিনবাজারে ছয় ছাত্রকে গ্রামবাসী কর্তৃক পিটিয়ে হত্যার ঘটনা তদন্তে স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের পক্ষে পুলিশের অবস্থান, এর আগে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর বর্বরোচিত হামলা, হরতালে মিছিলে অংশ নেয়া নারীদের ওপর পুলিশের ঝাঁপিয়ে পড়া এবং বেধড়ক লাঠিপেটা, বিরোধী জোটের রাজনৈতিক নেতাদের আটকের পরই রিমান্ড ও টিএফআই সেলে নিয়ে নির্যাতন, দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আটক করতে এসে পত্রিকা অফিসে হামলা ও পুলিশের যুদ্ধংদেহী আচরণ, সম্পাদককে টিএফআই সেলে নিয়ে নির্যাতন, সম্প্রতি অনলাইন সংবাদ সংস্থা শীর্ষ নিউজ ও শীর্ষ কাগজের সম্পাদক একরামুল হককে আটক করে চোর-ডাকাতের মতো হাতকড়া পরিয়ে আদালতে হাজির এবং পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
জয়নুল আবদিন ফারুকের ঘটনা তদন্তে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল জলিলকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তদন্তের ফলাফল এখনও আলোর মুখ দেখেনি। এ ঘটনায় উল্টো পুলিশ বাদী হয়ে ফারুকসহ ১২/১৩ জন আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। আর হামলাকারী পুলিশ সদস্য এডিসি হারুন ও এসি বিপ্লব কুমার সরকার চিকিত্সার নামে হাসপাতালে ভর্তি হয়। কিছুদিন আগে এডিসি হারুন ১৫ দিনের ছুটি নিয়ে আমেরিকা গিয়ে এখনও ফিরে আসেনি। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুল কাদেরের ডাকাতির ঘটনা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় খিলগাঁও থানার ওসি হেলাল উদ্দিন, এসআই আলম বাদশা এবং এএসআই তৌহিদুর রহমানকে হাইকোর্টের নির্দেশে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে আইন সচিবকে এ ঘটনা তদন্তের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। কোম্পানীগঞ্জে পুলিশের সহযোগিতায় কিশোর মিলনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি রফিক উল্লাহসহ ৪ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার জেলা পুলিশ সুপার হারুন-উর-রশিদ হায়দারী জানিয়েছেন, এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কমিটির প্রধান মাহবুব রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, প্রতিবেদনের সার-সংক্ষেপ হলো—‘দায়িত্ব পালনে পুলিশের গাফিলতি।’ তারা মিলনকে রক্ষায় যথাযথ দায়িত্ব পালন করেনি। এজন্য ওসি রফিক উল্লাহ, এসআই আকরাম শেখ ও দুই কনস্টেবল আবদুর রহিম ও হেমারঞ্জন চাকমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছেন, মুষ্টিমেয় কিছু সদস্য ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তবে পুলিশ সদস্যরা সততা, নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। যাদের বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সাভারের আমিনবাজারে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরের ঘটনায় পুলিশের বিভাগীয় পর্যায়ে তদন্ত চলছে। কাদেরের ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে তার দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পরই প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। তবে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এবং প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বরাবরই বলছেন, এগুলো বিচ্ছিন ঘটনা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, ‘আমার পুলিশ বাহিনী’ কখনও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে পারি না। যদি এরকম কিছু হয়ে থাকে তবে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, আদালতের নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এপর্যন্ত আলোচিত কোনো ঘটনায়ই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশ সদর দফতর থেকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
ঢাবি ছাত্র কাদের প্রসঙ্গে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান আদালতে উপস্থিত হয়ে বলেছেন, পুলিশ কাস্টডিতে নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্মমভাবে নির্যাতন করেছে। এটা লজ্জাজনক। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে একজন পুলিশ বলেছে, পুলিশকে লাঠি দেয়া হয়েছে কি চুমো খাওয়ার জন্য? জনগণের স্বার্থরক্ষার জন্য। সেই লাঠিকে ব্যবহার করা হয়েছে একজন ছাত্রের ওপর। তার মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। ওসি বলেছেন, গণপিটুনিতে আহত হয়েছে। তবে যারা গণপিটুনি দিয়েছে, তাদের ধরা সম্ভব হয়নি। বারবার এই গণপিটুনির কথা বলে ৫ জন, ৬ জন করে হত্যা করা হলো। এতে গণপিটুনি বৈধতা পাচ্ছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা যদি গণপিটুনিকে বৈধতা দেয়ার কাজে উত্সাহ দেন, তাহলে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোথায় যাবে? এ সময় আদালত বলেন, পুলিশের মানুষকে পেটানোর কোনো অধিকার নেই। পেটানোর দায়ে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে।
এমইউ আহমেদ হাসপাতালে : পুলিশের অমানবিক নির্যাতনে আশঙ্কাজনক অবস্থায় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে চিকিত্সাধীন আছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এমইউ আহমদ। হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সংশ্লিষ্ট চিকিত্সক বলছেন, এমইউ আহমেদের জীবন সঙ্কটাপন্ন। তিনি হাইরিস্ক পেশেন্ট। ৭২ ঘণ্টা পার না হওয়া পর্যন্ত তার অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না। গত বুধবার রাত দেড়টায় সাদা পোশাকধারী পুলিশ এমইউ আহমেদকে তার ১১৬, সেগুনবাগিচার বাসা থেকে গ্রেফতার করে। পরিবারের অভিযোগ, গ্রেফতারের সময়ই তাকে কিলঘুষি মারা হয়। তছনছ করা হয় বাড়ির মালামালা। গ্রেফতারের পর কিলঘুষি মেরে গাড়িতে ওঠায় ডিবি পুলিশ। পরে নেয়া হয় মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে (ডিবি)। সেখানে তাকে আরও নির্যাতন চালানো হয় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। তারা জানান, নির্যাতনের একপর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরদিন ভোরে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় ডিবি পুলিশ নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত ডাক্তাররা অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে তাকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেয়ার পরামর্শ দেন। বর্তমানে হাসপাতালে গভীর পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে তাকে। তবে ডিবি পুলিশের এডিসি মেহেদি হাসান সাংবাদিকদের জানান, অ্যাডভোকেট এমইউ আহমদকে নির্যাতন করা হয়নি। পুলিশ আটক করে গাড়িতে তোলার পরই তিনি জানান, তার বুকে ব্যথা হচ্ছে।
কণ্ঠশিল্পী রিজিয়া পারভীনের অভিযোগ : পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন করেছেন কণ্ঠশিল্পী রিজিয়া পারভীন। পুলিশি হামলার প্রতিবাদে গত ১৬ জুন রাজধানীর একটি রেস্তোরাঁয় সংবাদ সম্মেলনে তিনি অভিযোগ করে বলেন, ১২ জুনের হরতালে জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠনের (জাসাস) একটি মিছিলে অংশ নেয়ায় পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন তিনি। ওই দিন বেলা ১২টার দিকে জাসাসের একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল পেট্রোবাংলা কার্যালয় থেকে এফডিসির গেটের সামনে গেলে হঠাত্ করে পুলিশ আক্রমণ করে। এ সময় পুলিশ মধ্যযুগীয় কায়দায় তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রিজিয়া পারভীন অভিযোগ করেন, পুলিশ হাত ধরে টানাহেঁচড়া করে তার সম্মানহানি করেছে। তিনি বলেন, বর্তমানে আমি শারীরিকভাবে গুরুতর অসুস্থ। আমার ওপর কেন এই নির্যাতন? একজন শিল্পীর ওপর হামলার ঘটনা গোটা জাতির জন্য লজ্জাজনক। সবাই মিলে এর প্রতিকার করা উচিত। এর আগে বঙ্গোপসাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিলের দাবিতে কর্মসূচি দেয়ায় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের ওপর হামলা চালায় পুলিশ। এ ঘটনায় ঢাকায় হরতাল পালন করা হলে সেখানেও পুলিশ হামলা করে। অন্যদিকে আমেরিকায় চিকিত্সা নিতে যাওয়ার আগে জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন, পুলিশ হত্যার উদ্দেশ্যে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিনি আত্মরক্ষার জন্য দৌড়ে ন্যামভবনের একটি কক্ষে গিয়েও তাদের হাত থেকে রক্ষা পাননি। ন্যাম ভবনের ফ্ল্যাট থেকে টানাহেঁচড়া করে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপকে বিবস্ত্র্র করে লাঠিপেটা করেছে। তবে সেদিনের পুলিশের বেসামাল হামলার দৃশ্য মিডিয়ায় ফলাওভাবে প্রচার হওয়ায় দেশে-বিদেশে বহু লোক তা প্রত্যক্ষ করেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার কারণে পুলিশের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। পুলিশ বাহিনীতে দলীয় পরিচয়ে নিয়োগ দেয়ার ফলে তারা কমান্ড মানছে না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ বাহিনীতে দুটি বিশেষ এলাকার লোকদের প্রাধান্য দিয়ে নিয়োগ দেয়া হয়। বর্তমানে পুলিশের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদের বেশিরভাগই গোপালগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলার বাসিন্দা। এই দুই অঞ্চলের বিশ্বস্ত এবং অনুগত পুলিশ সদস্যরা গুরত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এসব পুলিশ সদস্যের সঙ্গে মন্ত্রী, এমপি, উপদেষ্টাদের সরাসরি যোগাযোগ থাকায় তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশনাও উপেক্ষা করে চলছে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ওইসব দলীয় পৃষ্ঠপোষক পুলিশ সদস্যরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনাও সঠিকভাবে মানছেন না । কেননা তারা একাধিক নেতা, মন্ত্রী ও এমপির আশীর্বাদপুষ্ট। তাদেরকে সহজেই বদলি ও শাস্তিও দিতে ব্যর্থ হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রসঙ্গত, গত হরতালে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর হামলাকারী দুই পুলিশ কর্মকর্তাই কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা। এখন পর্যন্ত ওই ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদ্বয়ের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
সুপ্রিমকোর্টের খ্যাতনামা আইনজীবী অ্যাডভোকেট এমইউ আহমেদকে আটক এবং নির্যাতনের কারণে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আব্দুল কাদেরকে আটকের পর ডাকাত সাজিয়ে নির্যাতন, নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জে ডাকাত সন্দেহে কিশোর মিলনকে পিটিয়ে হত্যা, আমিনবাজারে ছয় ছাত্রকে গ্রামবাসী কর্তৃক পিটিয়ে হত্যার ঘটনা তদন্তে স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের পক্ষে পুলিশের অবস্থান, এর আগে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর বর্বরোচিত হামলা, হরতালে মিছিলে অংশ নেয়া নারীদের ওপর পুলিশের ঝাঁপিয়ে পড়া এবং বেধড়ক লাঠিপেটা, বিরোধী জোটের রাজনৈতিক নেতাদের আটকের পরই রিমান্ড ও টিএফআই সেলে নিয়ে নির্যাতন, দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আটক করতে এসে পত্রিকা অফিসে হামলা ও পুলিশের যুদ্ধংদেহী আচরণ, সম্পাদককে টিএফআই সেলে নিয়ে নির্যাতন, সম্প্রতি অনলাইন সংবাদ সংস্থা শীর্ষ নিউজ ও শীর্ষ কাগজের সম্পাদক একরামুল হককে আটক করে চোর-ডাকাতের মতো হাতকড়া পরিয়ে আদালতে হাজির এবং পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
জয়নুল আবদিন ফারুকের ঘটনা তদন্তে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল জলিলকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তদন্তের ফলাফল এখনও আলোর মুখ দেখেনি। এ ঘটনায় উল্টো পুলিশ বাদী হয়ে ফারুকসহ ১২/১৩ জন আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। আর হামলাকারী পুলিশ সদস্য এডিসি হারুন ও এসি বিপ্লব কুমার সরকার চিকিত্সার নামে হাসপাতালে ভর্তি হয়। কিছুদিন আগে এডিসি হারুন ১৫ দিনের ছুটি নিয়ে আমেরিকা গিয়ে এখনও ফিরে আসেনি। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আব্দুল কাদেরের ডাকাতির ঘটনা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় খিলগাঁও থানার ওসি হেলাল উদ্দিন, এসআই আলম বাদশা এবং এএসআই তৌহিদুর রহমানকে হাইকোর্টের নির্দেশে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে আইন সচিবকে এ ঘটনা তদন্তের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। কোম্পানীগঞ্জে পুলিশের সহযোগিতায় কিশোর মিলনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি রফিক উল্লাহসহ ৪ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার জেলা পুলিশ সুপার হারুন-উর-রশিদ হায়দারী জানিয়েছেন, এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কমিটির প্রধান মাহবুব রশীদ সাংবাদিকদের বলেন, প্রতিবেদনের সার-সংক্ষেপ হলো—‘দায়িত্ব পালনে পুলিশের গাফিলতি।’ তারা মিলনকে রক্ষায় যথাযথ দায়িত্ব পালন করেনি। এজন্য ওসি রফিক উল্লাহ, এসআই আকরাম শেখ ও দুই কনস্টেবল আবদুর রহিম ও হেমারঞ্জন চাকমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছেন, মুষ্টিমেয় কিছু সদস্য ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তবে পুলিশ সদস্যরা সততা, নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। যাদের বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সাভারের আমিনবাজারে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাদেরের ঘটনায় পুলিশের বিভাগীয় পর্যায়ে তদন্ত চলছে। কাদেরের ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে তার দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পরই প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। তবে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এবং প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বরাবরই বলছেন, এগুলো বিচ্ছিন ঘটনা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, ‘আমার পুলিশ বাহিনী’ কখনও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে পারি না। যদি এরকম কিছু হয়ে থাকে তবে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, আদালতের নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এপর্যন্ত আলোচিত কোনো ঘটনায়ই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশ সদর দফতর থেকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
ঢাবি ছাত্র কাদের প্রসঙ্গে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান আদালতে উপস্থিত হয়ে বলেছেন, পুলিশ কাস্টডিতে নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্মমভাবে নির্যাতন করেছে। এটা লজ্জাজনক। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে একজন পুলিশ বলেছে, পুলিশকে লাঠি দেয়া হয়েছে কি চুমো খাওয়ার জন্য? জনগণের স্বার্থরক্ষার জন্য। সেই লাঠিকে ব্যবহার করা হয়েছে একজন ছাত্রের ওপর। তার মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। ওসি বলেছেন, গণপিটুনিতে আহত হয়েছে। তবে যারা গণপিটুনি দিয়েছে, তাদের ধরা সম্ভব হয়নি। বারবার এই গণপিটুনির কথা বলে ৫ জন, ৬ জন করে হত্যা করা হলো। এতে গণপিটুনি বৈধতা পাচ্ছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা যদি গণপিটুনিকে বৈধতা দেয়ার কাজে উত্সাহ দেন, তাহলে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোথায় যাবে? এ সময় আদালত বলেন, পুলিশের মানুষকে পেটানোর কোনো অধিকার নেই। পেটানোর দায়ে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে।
এমইউ আহমেদ হাসপাতালে : পুলিশের অমানবিক নির্যাতনে আশঙ্কাজনক অবস্থায় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে চিকিত্সাধীন আছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এমইউ আহমদ। হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সংশ্লিষ্ট চিকিত্সক বলছেন, এমইউ আহমেদের জীবন সঙ্কটাপন্ন। তিনি হাইরিস্ক পেশেন্ট। ৭২ ঘণ্টা পার না হওয়া পর্যন্ত তার অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না। গত বুধবার রাত দেড়টায় সাদা পোশাকধারী পুলিশ এমইউ আহমেদকে তার ১১৬, সেগুনবাগিচার বাসা থেকে গ্রেফতার করে। পরিবারের অভিযোগ, গ্রেফতারের সময়ই তাকে কিলঘুষি মারা হয়। তছনছ করা হয় বাড়ির মালামালা। গ্রেফতারের পর কিলঘুষি মেরে গাড়িতে ওঠায় ডিবি পুলিশ। পরে নেয়া হয় মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে (ডিবি)। সেখানে তাকে আরও নির্যাতন চালানো হয় বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। তারা জানান, নির্যাতনের একপর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরদিন ভোরে তাকে অজ্ঞান অবস্থায় ডিবি পুলিশ নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত ডাক্তাররা অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে তাকে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নেয়ার পরামর্শ দেন। বর্তমানে হাসপাতালে গভীর পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে তাকে। তবে ডিবি পুলিশের এডিসি মেহেদি হাসান সাংবাদিকদের জানান, অ্যাডভোকেট এমইউ আহমদকে নির্যাতন করা হয়নি। পুলিশ আটক করে গাড়িতে তোলার পরই তিনি জানান, তার বুকে ব্যথা হচ্ছে।
কণ্ঠশিল্পী রিজিয়া পারভীনের অভিযোগ : পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন করেছেন কণ্ঠশিল্পী রিজিয়া পারভীন। পুলিশি হামলার প্রতিবাদে গত ১৬ জুন রাজধানীর একটি রেস্তোরাঁয় সংবাদ সম্মেলনে তিনি অভিযোগ করে বলেন, ১২ জুনের হরতালে জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠনের (জাসাস) একটি মিছিলে অংশ নেয়ায় পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন তিনি। ওই দিন বেলা ১২টার দিকে জাসাসের একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল পেট্রোবাংলা কার্যালয় থেকে এফডিসির গেটের সামনে গেলে হঠাত্ করে পুলিশ আক্রমণ করে। এ সময় পুলিশ মধ্যযুগীয় কায়দায় তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রিজিয়া পারভীন অভিযোগ করেন, পুলিশ হাত ধরে টানাহেঁচড়া করে তার সম্মানহানি করেছে। তিনি বলেন, বর্তমানে আমি শারীরিকভাবে গুরুতর অসুস্থ। আমার ওপর কেন এই নির্যাতন? একজন শিল্পীর ওপর হামলার ঘটনা গোটা জাতির জন্য লজ্জাজনক। সবাই মিলে এর প্রতিকার করা উচিত। এর আগে বঙ্গোপসাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাতিলের দাবিতে কর্মসূচি দেয়ায় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের ওপর হামলা চালায় পুলিশ। এ ঘটনায় ঢাকায় হরতাল পালন করা হলে সেখানেও পুলিশ হামলা করে। অন্যদিকে আমেরিকায় চিকিত্সা নিতে যাওয়ার আগে জয়নুল আবদিন ফারুক বলেছেন, পুলিশ হত্যার উদ্দেশ্যে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিনি আত্মরক্ষার জন্য দৌড়ে ন্যামভবনের একটি কক্ষে গিয়েও তাদের হাত থেকে রক্ষা পাননি। ন্যাম ভবনের ফ্ল্যাট থেকে টানাহেঁচড়া করে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপকে বিবস্ত্র্র করে লাঠিপেটা করেছে। তবে সেদিনের পুলিশের বেসামাল হামলার দৃশ্য মিডিয়ায় ফলাওভাবে প্রচার হওয়ায় দেশে-বিদেশে বহু লোক তা প্রত্যক্ষ করেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার কারণে পুলিশের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। পুলিশ বাহিনীতে দলীয় পরিচয়ে নিয়োগ দেয়ার ফলে তারা কমান্ড মানছে না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ বাহিনীতে দুটি বিশেষ এলাকার লোকদের প্রাধান্য দিয়ে নিয়োগ দেয়া হয়। বর্তমানে পুলিশের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদের বেশিরভাগই গোপালগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলার বাসিন্দা। এই দুই অঞ্চলের বিশ্বস্ত এবং অনুগত পুলিশ সদস্যরা গুরত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। এসব পুলিশ সদস্যের সঙ্গে মন্ত্রী, এমপি, উপদেষ্টাদের সরাসরি যোগাযোগ থাকায় তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশনাও উপেক্ষা করে চলছে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ওইসব দলীয় পৃষ্ঠপোষক পুলিশ সদস্যরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনাও সঠিকভাবে মানছেন না । কেননা তারা একাধিক নেতা, মন্ত্রী ও এমপির আশীর্বাদপুষ্ট। তাদেরকে সহজেই বদলি ও শাস্তিও দিতে ব্যর্থ হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রসঙ্গত, গত হরতালে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর হামলাকারী দুই পুলিশ কর্মকর্তাই কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা। এখন পর্যন্ত ওই ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদ্বয়ের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
No comments:
Post a Comment