বশীর আহমেদ
নিরপরাধ ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে নিষ্ঠুর এবং বর্বর নির্যাতন চালাচ্ছে র্যাব। র্যাবের নির্যাতনের এই ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি)। গত ২০ এপ্রিল প্রকাশিত কমিশনের এক রিপোর্টে র্যাব সদস্যদের নির্যাতনের দুটি কেস স্টাডি তুলে ধরা হয়েছে। কেস স্টাডিতে রাজীব এবং সজীব নামে পুরান ঢাকার দুই যুবকের ওপর চালানো নির্মম নির্যাতন এবং ক্রসফায়ার থেকে তাদের বেঁচে যাওয়ার লোমহর্ষক কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। এ সম্পর্কে র্যাবের পরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া) কমান্ডার সোয়াহেলের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের রিপোর্টটি আমাদের হাতে আসেনি। আমরা এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করব না।
রিপোর্টটিতে বলা হয়, নাহিদুল হক সজীব, বয়স ২৫। লালবাগ থানার অধীন চাঁনখারপুল এলাকায় তার ঘর। সে পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। গত ৫ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে কিছু কেনাকাটার জন্য ঘর থেকে বের হয় সজীব। পাশেই তার ব্যবসা অফিস। অফিসের কাছাকাছি এলেই একদল র্যাব সদস্য সজীবকে থামায়। র্যাব সদস্যরা সজীবের কাছে তার নাম, সে কি করে এগুলো জানতে চায়। সজীব তার নাম এবং ব্যবসার কথা বলার পর এক র্যাব সদস্য সজীবকে বলে ‘তুই একজন ছিনতাইকারী।’ একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে র্যাব সদস্যরা তার চোখ বেঁধে ফেলে গাড়িতে তোলে। চোখ বাঁধার পর তার মুখের ওপর আরও একটি মাস্ক পরিয়ে দেয়া হয়। সজীবকে নিয়ে যাওয়া হয় লালবাগ কেল্লার পাশে অবস্থিত র্যাব-১০-এর ক্যাম্পে। মুখোশ পরিয়ে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে ক্যাম্পের দোতলার একটি সেলে সজীবকে রাখা হয়। গভীর রাতে জিজ্ঞাসাবাদের নামে শুরু হয় তার ওপর নির্যাতন। সেল থেকে কয়েক গজ দূরে পাশের আরেকটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একজন র্যাব কর্মকর্তা তার এবং তার বাবার নাম জানতে চান। সজীব উত্তর দেয়ার পর ওই কর্মকর্তা বলেন, আমি তোকেই খুঁজছি। এ কথা বলেই ওই কর্মকর্তা একটি লাঠি দিয়ে সজীবকে পায়ের তলায়, পিঠে ও কাঁধে বেধড়ক পেটাতে থাকেন। এক পর্যায়ে সজীব অজ্ঞান হয়ে পড়ে। পরে র্যাবেরই একজন ডাক্তার এসে তাকে চিকিত্সা দেন। সজীবের জ্ঞান ফেরার পর র্যাব সদস্যরা তাকে এক প্যাক জুস খেতে দেয়। রাতে র্যাব সদস্যরা সজীবের পায়ের আঙ্গুলের সঙ্গে হ্যাসকে ট্যাগ লাগিয়ে বারবার ইলেকট্রিক শক দেয়। তবে তাকে রাতে আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে দেয়া হয়।
৬ এপ্রিল বেলা আড়াইটায় সজীবকে জানানো হয় র্যাবের একজন বড় কর্মকর্তা এসেছেন। সজীবকে ওই কর্মকর্তার সামনে হাজির করা হয়। ওই কর্মকর্তা তার অধস্তন কর্মকর্তাদের কাছে সজীবের গ্রেফতারের ব্যাপারে জানতে চান। জুনিয়র র্যাব কর্মকর্তারা জানান, সন্দেহ করে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তথ্য বের করার চেষ্টা হচ্ছে। এ সময় ওই কর্মকর্তা বলেন, ঠিক আছে তথ্য বের করে রিপোর্ট তৈরি কর। প্রয়োজন হলে আরও পেটাবে।
এরপর সজীবকে অন্য একটি রুমে নেয়া হয়, সেখানে একজন ডাক্তার তাকে আবার পরীক্ষা করেন।
৭ এপ্রিল রাত ৩টায় র্যাব সদস্যরা সজীবকে অন্য একটি রুমে নিয়ে যায়। সেখানে তারা দীর্ঘ সময় ধরে নানাভাবে সজীবের ওপর নির্যাতন চালায়। তার আঙ্গুলে সূচ ঢোকানো হয়। ধারালো ধাতব ব্লেড দিয়ে সজীবের নখ কেটে ফেলা হয়। এরপর ওই নখের ওপর এক ধরনের স্প্রে করা হয়, যাতে আঘাতের চিহ্ন বোঝা না যায়। কয়েক দিন পরে সজীবের পায়ের তলায় অস্ত্রের বাঁট দিয়ে নির্মমভাবে পেটানো হয়। এখানেই নির্যাতনের শেষ নয়, র্যাব সদস্যরা সজীবের কানের মধ্যে শক্ত কাঠি ঢুকিয়ে দেয়। এ সময় সজীবের কান দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। এই নির্যাতনের মধ্যে সজীব জানতে চায় কি তার অপরাধ। তার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে র্যাব সদস্যরা আরও নির্যাতন চালায়।
৮ এপ্রিল রাত আড়াইটায় নতুন ৩ র্যাব সদস্য সজীবকে যেখানে আটক রাখা হয়েছে সেখানে আসে। তারা এসেই সজীবকে উপর্যুপরি লাথি মারতে থাকে। পরে মেঝেতে ফেলে বুট দিয়ে নির্মমভাবে পাড়াতে থাকে। সজীব অজ্ঞান হওয়ার আগ পর্যন্ত এই নির্যাতন চলতে থাকে।
৮ এপ্রিল রাতে র্যাব সদস্যরা সজীবের কাছে এসে বলে অজু করে আয়। পরে তাকে সূরা ইয়াসিন এবং সূরা আর-রাহমানের কয়েকটা আয়াত দিয়ে তা পাঠ করতে বলে। সজীব তখন বারবার ওই আয়াতগুলো পড়তে থাকে। সজীবকে আটকের একদিন পর অর্থাত্ ৬ এপ্রিল হোসনি দালান এলাকা থেকে র্যাব সদস্যরা আটক করে কাওসার হোসেন রাজীবকে। রাজীবের বয়স ২৪। প্লাস্টিকের বোতলের ব্যবসা তার। রাজীব ও সজীব সম্পর্কে কাজিন।
তখন রাত আনুমানিক ৮টা। রাজীব তার বাবা আওলাদ হোসেনের সঙ্গে মসজিদে নামাজ পড়তে যাচ্ছিল। পথে সাদা পোশাকে ৮ জনের র্যাবের একটি দল রাজীবকে থামায়। র্যাব সদস্যরা রাজীবকে বলে তাকে তাদের সঙ্গে যেতে হবে। রাজীব এ সময় জানতে চায় তার অপরাধ কী। তখন র্যাব সদস্যরা বলেন একদম চুপ।
রাজীবের বাবা আওলাদ হোসেন এবং ছোট ভাই রনি এ সময় এগিয়ে এসে জানতে চায় কেন রাজীবকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ সময় উত্তেজিত র্যাব সদস্যরা অস্ত্র বের করে বলে কথা বললে গুলি করে মেরে ফেলব। এরপর র্যাব সদস্যরা রাজীবের চোখ এবং মুখ কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে একটি মাইক্রোবাসে করে র্যাব-১০-এর লালবাগ কেল্লার পাশে অবস্থিত ক্যাম্পে নিয়ে যায়। চোখ-মুখ বাঁধা অবস্থায় রাজীবকে প্রায় ১ ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়। এরপর রাজীবকে র্যাবের এক সিনিয়র কর্মকর্তার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। একটি চেয়ারে তাকে চোখ-মুখ বাঁধা অবস্থায় বসানো হয়। এ সময় তার পেছনে বাঁধা হয়। পা দুটি রাখা হয় অন্য একটি চেয়ারের ওপর। হকিস্টিক দিয়ে র্যাব সদস্যরা তার পায়ের তলায় নির্মমভাবে পেটাতে শুরু করে। এরপর আঙুলে লোহার ক্লিপ লাগিয়ে বারবার ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়। প্রায় ১ ঘণ্টা চলে এই নির্যাতন। নির্যাতনের পর তাকে রুমে নিয়ে আসা হয়। তাকে রাতের বেঁচে যাওয়া কিছু খাবার খেতে দেয়া হয়, যা খাওয়ার উপযুক্ত ছিল না। আধ ঘণ্টা পর রাজীবকে আবার অন্য একটি রুমে নেয়া হয়। এ সময় নির্যাতন আর আঘাতের কারণে রাজীব কাঁপছিল। সে হাঁটতে পারছিল না। তখন র্যাব সদস্যরা তাকে হাঁটতে বলে। রাজীব জানায়, তার পায়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। নির্যাতনকারী র্যাব সদস্যরা এখন যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে দেব এই কথা বলে আবার পেটাতে শুরু করে। রাজীবের আঙুল এবং নখের মধ্যে সূই ঢুকিয়ে দেয়। রুমের মেঝেতে পড়ে থাকে রাজীব। নিষ্ঠুর র্যাব সদস্যরা এ সময় রাজীবকে আবার ওঠে দাঁড়াতে বলে। রাজীব জানায়, তার দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। এরপর রাজীবের শরীরের কয়েকটি ধাতব পাত জড়িয়ে ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়। ইলেকট্রিক শকে রাজীব দূরে ছিটকে পড়ে। র্যাব সদস্যরা তখন বলে, তুই নাকি দাঁড়াতে পারবি না, এখন দেখলি তো তুই লাফাতেও পারিস।
এভাবে নির্যাতন চালিয়ে র্যাব-১০-এর সদস্যরা রাজীবকে তাদের নির্দেশমত স্বীকারোক্তি দিতে বলে। আর স্বীকারোক্তি না দিলে তাকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। ৭ এপ্রিল রাজীবকে নিয়ে র্যাব সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায় এবং ক্রসফায়ারে মারার ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করে। র্যাব সদস্যরা বারবার বলে তুই একজন ছিনতাইকারী।
৮ এপ্রিল মধ্যরাতে র্যাব সদস্যরা রাজীব এবং সজীবকে চোখ-মুখ বেঁধে একটি গাড়িতে করে আজিমপুর এলাকার দিকে যায়। গাড়ির মধ্যে যখন তাদের চোখ-মুখ খুলে দেয়া হয়, তখন তারা একে অন্যকে চিনতে পারে এবং একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। এ সময় তাদের ওপর আবার নির্যাতন চালানো হয়। সজীব এবং রাজীবকে নিয়ে র্যাব সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ায়। এক পর্যায়ে তাদের ক্রসফায়ারে মারার জন্য বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সোয়ারীঘাট এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় র্যাবের সঙ্গে পুলিশ এবং অন্যান্য এজেন্সির সদস্যরাও ছিল। র্যাব কর্মকর্তারা এ সময় রাজীব এবং সজীবকে দৌড়াতে বলে। কিন্তু তারা দৌড়াতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা জানে দৌড়ালে তাদের গুলি করা হবে। রাজীব এবং সজীব এক র্যাব কর্মকর্তার পা জড়িয়ে ধরে আকুতি জানায়, আমাদের মারবেন না। আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে চলুন। এ সময় আজিমপুর স্টাফ কোয়ার্টার থেকে দু’জন গার্ডকে নিয়ে আসা হয়েছিল, যারা র্যাবের নির্দেশে রাজীব এবং সজীবকে ছিনতাইকারী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়ে একটি কাগজে সই করে। এরই মধ্যে সকাল হয়ে আসে। র্যাব সদস্যরা ওই রাতে রাজীব এবং সজীবকে না মেরে ফেরত নিয়ে যায়। র্যাবের এক কর্মকর্তা তাদের বলেন, তোদের মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত ছিল। হয়তো জীবনে কোনো ভালো কাজ করেছিলি তাই বেঁচে গেলি। নিয়মিত নামাজ পড়বি।
৯ এপ্রিল সকালবেলা র্যাব-১০-এর ক্যাম্পে সজীব এবং রাজীবকে নিয়ে যাওয়ার পর এক পর্যায়ে পায়ে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত রাজীবকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নেয়া হয়। সজীবকে হাজির করা হয় র্যাবের এক সিনিয়র কর্মকর্তার রুমে। ওই কর্মকর্তা উত্তেজিত কণ্ঠে গালাগাল দিয়ে বলেন, মন্ত্রী-এমপি দিয়ে ফোন করিয়ে ক্ষমতা দেখাস। যা বেঁচে গেলি বলে তিনি সজীবকে পেটাতে থাকেন। এক পর্যায়ে বলেন, আমরা আমাদের ক্ষমতা দেখালাম। এরপর ছিনতাই মামলা দিয়ে দু’জনকে চালান করে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন র্যাব কর্মকর্তা। বিকেলের দিকে হাসপাতাল থেকে রাজীবকে ফিরিয়ে আনা হয়। সজীব ও রাজীব দুজনের বুকে নাম লিখে সামনের টেবিলে দুটি ছুরি রেখে ছবি তোলা হয়। এরপর লালবাগ থানায় নিয়ে ছিনতাইকারি বলে দ্রুত বিচার আইনে মামলা রুজু করতে বললে ডিউটি অফিসার প্রথমে অপারগতা জানান। তার যুক্তি, ছিনতাই করেনি- করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, এ কারণে দ্রুত বিচার আইনে মামলা হয় না। ছিনতাই করলে ছিনতাইকৃত মালামালের দরকার। তখন র্যাব কর্মকর্তা সজীব ও রাজীবকে আটকের সময় তাদের কাছে থাকা মোবাইল এবং টাকা ছিনতাইকৃত বলে উল্লেখ করে মামলা দায়ের করতে বলেন। এক পর্যায়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ডিউটি অফিসার কথা বলেন এবং মামলা রুজু করেন। ১০ এপ্রিল সজীব ও রাজীবকে কোর্টে চালান দেয় পুলিশ। কোর্টে তাদের জামিনের আবেদন মঞ্জুর হয়। র্যাব সদস্যরা পুলিশের হাতে তাদের তুলে দেয়ার আগে শাসিয়ে দেয় নির্যাতনের কাহিনী কোথাও প্রকাশ করলে তাদের মেরে ফেলা হবে। কিন্তু জীবনের মায়া উপেক্ষা করেই মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন সজীব ও রাজীব। তারা জানান, মুক্ত হওয়ার পরও তাদের হুমকি দেয়া হচ্ছে টেলিফোনে।
এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের পক্ষ থেকে র্যাবের এই বর্বর অপরাধের তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির পাশাপাশি অবিলম্বে র্যাব বিলুপ্ত করার দাবি জানানো হয়।
No comments:
Post a Comment