বশীর আহমেদ
মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টে বাংলাদেশে বিচার বিভাগ দলীয়করণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েই চলেছে। তাদের হাতে গুম ও অপহরণ অব্যাহতভাবে চলছে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর রাজনৈতিক সহিংসতা, হয়রানি ও নির্যাতন বেড়েই চলেছে। সভা-সমাবেশের অধিকারকে সীমিত করা হয়েছে। সরকার গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করছে এবং সাংবাদিকরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সাধারণ মানুষের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর থেকে প্রকাশিত ২০১০ সালের মানবাধিকার রিপোর্টে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের গত বছরের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সংবলিত এই রিপোর্ট ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশ করা হয়।
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ৪২ পৃষ্ঠার রিপোর্টে সরকার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নির্যাতন, গণমাধ্যম দলনসহ মানবাধিকারের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। রিপোর্টে বাংলাদেশের জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক আমার দেশ বন্ধ করে দেয়া, পত্রিকাটির সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার ও আদালত অবমাননা মামলায় সাজা এবং সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমানকে সাজা দেয়ার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পায়।
মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েই চলেছে। আটক অবস্থায় মৃত্যু, নির্যাতন, অযৌক্তিকভাবে গ্রেফতার এবং ডিটেনশনের জন্য এই নিরাপত্তা বাহিনী দায়ী। বিচারবহির্ভূত এসব হত্যা এবং বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত র্যাবের ব্যাপারে কোনো ধরনের তদন্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। এটা গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্য এ ধরনের অপরাধ করেছে এই নিশ্চয়তা নিয়ে যে, তাদের কোনো শাস্তি হবে না। বিচারের আগেই কারাগারে মৃত্যুঝুঁকির পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কর্তৃপক্ষ নাগরিক অধিকারকে উপেক্ষা করেছে। বিচার বিভাগকে অব্যাহতভাবে রাজনীতিকরণ করায় বিচার ব্যবস্থায় বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে। এর ফলে বিশেষ করে বিরোধী দলের জন্য এখন ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার গণমাধ্যম এবং জনগণের বাকস্বাধীনতাকে সীমিত করে ফেলেছে। গণমাধ্যমগুলো সেলফ সেন্সরশিপ করতে বাধ্য হচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রতিনিয়ত হয়রানি করছে সাংবাদিকদের। সরকার সভা-সমাবেশের অধিকারকে সীমিত করেছে এবং অব্যাহত
রয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা। এটা এখন একটি বড় সমস্যা।
সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি অব্যাহত গতিতে চলছে এবং দুর্নীতির সঙ্গে যারা যুক্ত, তারা শাস্তির বাইরে থেকে যাচ্ছে। নারীর প্রতি বৈষম্য এবং নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা একটি ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে বাংলাদেশে। মানব পাচার এখনও বড় সমস্যা।
বিচারবহির্ভূত হত্যা : মার্কিন এ রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা অব্যাহতভাবে ঘটে চলেছে। এসব হত্যার কোনো ধরনের পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে রাজি হয়নি সরকার। ২০১০ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে ১২৭টি। এর মধ্যে ক্রসফায়ারই ১০১টি। র্যাব কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে ৬৮টি। আগের বছর র্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ছিল ৪১টি। এসব হত্যার ঘটনা তদন্তের জন্য সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
গুম ও অপহরণ : ২০১০ সালে বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুম এবং অপহরণের ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এ ব্যাপারে সঠিক পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও প্রচুর ঘটনা ঘটেছে। অনেক অপহরণের ঘটনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। অন্তত ৯টি গুমের ঘটনার সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনী জড়িত। কিছু ঘটনার সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যক্তিগত লোকজন জড়িত।
গুমের কয়েকটি ঘটনার বিবরণ দিয়ে রিপোর্টে বলা হয়, ২০১০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর থেকে মোহাম্মদ সেলিম নামে এক ফল ব্যবসায়ীকে র্যাব সদস্যরা তুলে নিয়ে যায়। এখন পর্যন্ত তার কোনো হদিস মেলেনি। ১৯ মার্চ ঠাকুরগাঁও থেকে র্যাব সদস্যরা আখতার সানী সরদারকে আটক করে। কিন্তু তারও কোনো খোঁজ মেলেনি। ২৫ জুন ওয়ার্ড কমিশনার মোহাম্মদ চৌধুরী আলমকে অপহরণ করা হয়। সরকার এখন পর্যন্ত চৌধুরী আলমকে উদ্ধার বা তার অপহরণকারীদের গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হয়েছে। চৌধুরী আলমকে আগে একবার অপহরণের চেষ্টা করা হয়। তখন ওই অপহরণ চেষ্টার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা ছিল র্যাবের এজেন্ট এবং তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
রাজনৈতিক সহিংসতা : বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরে রিপোর্টে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর রাজনৈতিক সহিংসতা, হয়রানি ও নিপীড়ন অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। গত এক বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় ২২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। সরকারি দলের অঙ্গসংগঠনগুলোর মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্বেও হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক সহিংসতায় আহত হয়েছে কমপক্ষে ১৩ হাজার ৯৯৯ জন।
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে ২০১০ সালে ৫৭৬টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এসব সহিংস ঘটনায় ৩৮ জন নিহত এবং ৫ হাজার ৬১৪ জন আহত হয়। এ সময় বিএনপির অভ্যন্তরীণ সহিংসতায় ৭ জন নিহত এবং আহত হয় ৯৪৬ জন।
বিচার বিভাগ দলীয়করণ : প্রতিবেদনে বলা হয়, যদিও নির্বাহী বিভাগ থেকে বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে আলাদা করা হয়েছে, তারপরও রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষই উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ দিচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক স্পর্শকাতর মামলার রায় রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। এ ঘটনা ঘটছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিরোধীদের জামিন ও ডিটেনশন দেয়ার ক্ষেত্রে। সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকার গত বছরের ১১ এপ্রিল ১৭ জন অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ দেয়। এদের মধ্যে দু’জনের বিরুদ্ধে অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
ওই দুই বিচারপতিকে তত্কালীন বিদায়ী প্রধান বিচারপতি ফজলুল করিম শপথ পড়াতে অস্বীকার করেন। ২৬ সেপ্টেম্বর সিনিয়র দুই বিচারপতিকে ডিঙিয়ে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে সরকার প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়। বিরোধী দলের নেতারা ওই নিয়োগের সমালোচনা করে বলেন, সরকারি দলের প্রতি অনুগত হওয়ার কারণেই তাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই প্রধান বিচারপতির এমন সময়ে অবসরে যাওয়ার কথা রয়েছে, যার ফলে তিনিই হবেন আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকবে ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ : মার্কিন মানবাধিকারের এ প্রতিবেদনে গণমাধ্যম দলনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানে গণমাধ্যম এবং বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলেও তা রক্ষায় বর্তমান সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের সমালোচনা করায় ইলেকট্রনিক মাধ্যমসহ দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রচণ্ড চাপ ও হুমকির মধ্যে রয়েছে। বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় চ্যানেল ওয়ান গত বছর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গত ১ জুন ঢাকা জেলা প্রশাসকের নির্দেশে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল দৈনিক আমার দেশ। গ্রেফতার করে ডিটেনশনে পাঠানো হয় পত্রিকাটির সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। পরে পুলিশের মামলায় দীর্ঘ সময় কারাগারে আটক রাখা হয় আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। আমার দেশ এক মাসেরও বেশি বন্ধ থাকার পর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে সরকারের সিদ্ধান্ত স্থগিত হওয়ায় পুনরায় পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। তবে পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কারাগারেই আটকে রাখা হয়।
আদালতের সমালোচনা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় ১৯ আগস্ট মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এক মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয় প্রতিবেদক অলিউল্লাহ নোমানকে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই প্রথমবারের মতো আদালত অবমাননার অভিযোগে আপিল বিভাগ কোনো সাংবাদিককে কারাদণ্ড দিলেন। রিপোর্টে বলা হয়, জনপ্রিয় টক শো ‘পয়েন্ট অব অর্ডার’ ডিজিএফআইর প্রতিনিয়ত হুমকির কারণে শেষ পর্যন্ত বন্ধ করতে বাধ্য হয়। রিপোর্টে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা একটি বড় সমস্যা হিসেবেই দেখা দিয়েছে। সরকার এবং সরকারি দলের সদস্যরা প্রতিনিয়ত সাংবাদিকদের হয়রানি করছেন। ২০১০ সালে অন্তত ৪ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১১৮ জন। আক্রমণের শিকার হয়েছেন ৪৩ জন।
সীমান্ত হত্যা : মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টে সীমান্ত হত্যার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১০ সালে সীমান্ত হত্যা ৩৩ শতাংশ বেড়েছে। সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ৯৮ বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করেছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু : ২০১০ সালে বাংলাদেশের কারাগারে মারা গেছে ৪৬ জন এবং পুলিশ কাস্টডিতে মারা গেছে ১০৯ জন। বাংলাদেশের কারাগারগুলোর ধারণক্ষমতা ২৯ হাজার ২৪০ জন। অথচ এসব কারাগারে আটকের সংখ্যা ছিল ৬৯ হাজার ৬৫০ জন।
No comments:
Post a Comment