স্টাফ রিপোর্টার
রাষ্ট্রকে মানবিক হওয়ার মিনতি জানিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমি রাষ্ট্রের কাছে মিনতি জানাচ্ছি, রাষ্ট্র তুমি মানবিক হও। হাজার হাজার গ্রামবাসীর নামে-বেনামে মামলা করো না। হুলিয়া জারি করো না।’
গতকাল বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ ছাত্রকল্যাণ ট্রাস্ট আয়োজিত ‘নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং যৌন হয়রানি প্রতিরোধে শিক্ষক-অভিভাবক, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
ড. মিজান বলেন, ‘আড়িয়ল বিলের হাজার হাজার গ্রামবাসী মামলার ভয়ে বাড়ি ফিরতে পারছে না। অত্যাচারিত হচ্ছে। পলাতক রয়েছে। গ্রেফতার হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘যেখানে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী সেখানকার মানুষের আহ্বানে সাড়া দিয়ে পদ্মার ওপারে বিমানবন্দর করার ঘোষণা দিয়েছেন, সেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র কেন অসংখ্য মানুষের নামে দায়ের করা বেনামি মামলা তুলে নেবে না!’
মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, ‘আইনের শাসনের অভাবে আমাদের রাষ্ট্র আজ এক অসীম ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। যেখানে নাগরিক সামান্য এক বিন্দুমাত্র। তাই সেই অসীম ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের কাছে আমরা মিনতি জানাতে পারি—‘রাষ্ট্র তুমি মানবিক হও।’ তিনি বলেন, ‘এটা মানতে খারাপ লাগে, এ অসীম ক্ষমতাধর রাষ্ট্র গুটিকয়েক দুষ্কৃতকারীর হাত থেকে নাগরিকদের বাঁচাতে পারবে না। এটা কোনো চ্যারিটি নয়। এটা তার ডিউটি।’ আমরা একটু সচেতন হলেই আমাদের এ অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
ড. মিজানুর রহমান বলেন, দেশে বর্তমানে সবক্ষেত্রে রাজনীতিকরণ হচ্ছে। চাকরিতে নিয়োগ, সামাজিক ও রাষ্ট্রের সব কার্যক্রম রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হচ্ছে।
সমাজ পরিবর্তনের জন্য এ সেমিনারে তিনি তিনটি প্রস্তাবও উত্থাপন করেন। এগুলো হলো, শিক্ষার্থী দেশের যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে বিষয়েই পড়ুক না কেন, ওই প্রতিষ্ঠানকে তার সব শিক্ষার্থীকে বছরে এক মাস গ্রামে গিয়ে আসল বাংলাদেশ দেখে আসা বাধ্যতামূলক করতে হবে। তিনি বলেন, ‘দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিরুদ্ধে হরতাল না দিয়ে আমরা ঘোষণা করতে পারি, আসুন আমরা দেশের জন্য একটি দিন কাজ করে সবাই ওই দিনের উপার্জন দুস্থদের জন্য ব্যয় করি।’ আসুন আমরা বছরের একটি দিন আমাদের চারপাশ নিজ হাতে পরিষ্কারের দায়িত্ব নিয়ে খোকাবাবুর কাজের চাপ কমিয়ে দেই।
তিনি আরও বলেন, ‘এ দেশে কেউ ভিআইপি নয়। সবাই সাধারণ নাগরিক। যে দেশে রাষ্ট্রের সব নাগরিককে বিশ্বকাপের টিকিটের জন্য শীত উপেক্ষা করে সারারাত অপেক্ষা করতে হয়, সেখানে সবাই সাধারণ।’
অধ্যাপক এম এম খানের সভাপতিত্বে সেমিনারে মুক্তিযুদ্ধে আট নম্বর সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল আবু উসমান চৌধুরী, অধ্যাপক মোস্তফা কামাল, বাংলাদেশ ছাত্রকল্যাণ ট্রাস্টের পরিচালক নুরে আলম তালুকদার বক্তৃতা করেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক নুরুল করিম নাসিম।
ড. মিজান ইভটিজিং বা যৌন হয়রানি সম্পর্কে বলেন, ‘যারা এ অপরাধ করছে তারা ভিন গ্রহের কেউ নয়। তারা আমাদের সমাজের অংশ, আমাদেরই আপনজন। তারা আমাদের প্রতিপক্ষ নয়। তাই শত্রুতা করে এ ধরনের ভয়ানক সামাজিক ব্যাধি দূর করা যায় না।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এমন একটি সমাজ গড়ে তুলেছি, যেখানে নারীকে বাজারের পণ্য হিসেবে গণ্য করা হয়।’
বেকারত্ব এ সমস্যার প্রধান কারণ নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তাহলে আমাদের দেশে যে সংখ্যক ভুখা-নাঙ্গা, আশ্রয়হীন আছে তাতে ঢাকার রাস্তায় নির্বিঘ্নে এত গাড়ি চলার কথা নয়। এসব বঞ্চিতরা কখনও এই গাড়িগুলোতে ইট মারে না। অথচ গাড়িতে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে আমাদের মতো শিক্ষিতজনেরা।’ ড. মিজান এ ধরনের ঘটনাকে সমাজের অবক্ষয় বলে উল্লেখ করেন। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হওয়ায় এবং আইন ভাঙার বলয় গড়ে তোলাকে তিনি এর জন্য দায়ী করেন। এ ঘটনা সমাজে প্রতিষ্ঠা করে—‘এ সমাজে অন্যায় করলে বিচার হয় না’। তিনি বলেন, ‘এ অবক্ষয়ের আরও একটি বড় কারণ হলো সবকিছুকে সরল ও সহজীকরণ।’
তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘যে শিক্ষক রাজনৈতিক পরিচয়ে শিক্ষক হন, তিনি ছাত্রদের কী শেখাবেন? যার নিজের স্বাধীন স্বপ্ন দেখার যোগ্যতা নেই, তিনি নতুন প্রজন্মকে কী স্বপ্ন দেখাবেন? আমাদের যে নৈতিক স্খলন ঘটেছে, তাতে কে আমাদের কাছে ভালো কিছু আশা করবে?’
No comments:
Post a Comment