স্টাফ রিপোর্টার
গত ৯ মাসে দেশের ৯০ নাগরিক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৭১ জনের প্রাণ গেছে ক্রসফায়ারে। পুলিশ তথা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে মারা গেছেন ৮৭ জন। হাজতে এ সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৫ জন। উল্লিখিত সময়ে জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত সাংবাদিকরাও বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৩ সাংবাদিক নিহত, ৬৬ জন আহত, ৪২ জন হমুকির সম্মুখীন এবং ৩৩ জন লাঞ্ছিত হয়েছেন। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাও এ সময় ব্যাপক হারে ঘটেছে।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের ৯ মাসের রিপোর্টে এ তথ্য পাওয়া গেছে। গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে এ রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। রিপোর্টে নাটোরে গামা হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ড পাওয়া ২২ আসামিকে খালাস করে দেয়ার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমা বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। অধিকার গুম করে হত্যার ব্যাপারে সরকারের ব্যাখ্যা দাবি করেছে।
প্রতি ৩ দিনে গড়ে ১টি বিচারবহির্ভূত হত্যা
অধিকারের রিপোর্টে বলা হয়েছে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন দেশের ৯০ নাগরিক। এর মধ্যে ৪০ জন র্যাব, ৩৩ জন পুলিশ, ১১ জন র্যাব ও পুলিশের যৌথ অভিযানে, ৫ জন র্যাব-পুলিশ-কোস্টগার্ডের যৌথ অভিযানে নিহত হন। এ সময় বিডিআরের হাতেও ১ জন নিহত হন। এদিকে ৯ মাসে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নির্যাতনে নিহত হয়েছেন ১৭ জন। এর মধ্যে ৩ জন র্যাব, ১৩ জন পুলিশ ও ১ জন বিডিআরের হাতে নিহত হয়েছেন। এ বছরে ৮৭ জন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে মারা গেছেন। এর মধ্যে ৫ জন ক্রসফায়ারে, ১৬ জন নির্যাতনে এবং ১ জন গুলিতে মারা গেছেন। এই সময়ে ৪৭ ব্যক্তি জেলহেফাজতে ‘অসুস্থতাজনিত’ কারণে মারা গেছেন। এছাড়া এ সময়ে ২ ব্যক্তি কোর্ট হেফাজতে, ১ জন থানায় এবং ১ জন র্যাব হেফাজতে মারা গেছেন।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সরকারি আচরণ
জাতীয় সংসদ এবং সংসদের বাইরে স্পিকারসহ সরকারের একাধিক মন্ত্রী-এমপি সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন উল্লেখ করে অধিকারের রিপোর্টে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য ও সরকারি উপদেষ্টার এ ধরনের বক্তব্যে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, এ ধরনের পরিস্থিতি সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের কাজের ক্ষেত্রে আরও কঠোর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। যার ফলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বাধাগ্রস্ত হবে।
সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা
নয় মাসে সাংবাদিকরা বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ সময়ে ৩ সাংবাদিক নিহত, ৬৬ জন আহত, ৪২ জন হুমকির সম্মুখীন এবং ৩৩ জন লাঞ্ছিত হয়েছেন। এই সময়ে ১৭ সাংবাদিকের ওপর হামলা, ২ জন গ্রেফতার, ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এ সময় সরকার দৈনিক আমার দেশ, চ্যানেল ওয়ান ও ফেসবুক বন্ধ করায় অধিকারের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
সন্ত্রাস দমন আইন ২০০৯ এ গ্রেফতার-নির্যাতন
অধিকার মনে করে, সন্ত্রাস দমন আইন ২০০৯ বলবত্ থাকলে দেশে ব্যাপক হারে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে এবং সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মীসহ ভিন্ন মতাবলম্বীরা নির্যাতনের শিকার হবেন।
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের ক্ষমা
নাটোরের আলোচিত সাব্বির আহাম্মেদ গামা হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ড পাওয়া ২০ জনের সাজা রাষ্ট্রপতি মওকুফ করে দেয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে অধিকার মনে করে, রাষ্ট্রপতির এ ধরনের ক্ষমা বিচারব্যবস্থার সঙ্গে একটি সাংঘর্ষিক অবস্থার সৃষ্টি করবে। বিচার শেষ হওয়ার আগেই ক্ষমা করে দিলে বিচার ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে এবং বিচার ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমে যাবে।
রাজনৈতিক সহিংসতা
পাবনা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অফিস সহকারী পদে নিয়োগ পরীক্ষায় স্থানীয় যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হামলার পাশাপাশি সারাদেশে সরকার সমর্থিত লোকদের সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে অধিকারের রিপোর্টে বলা হয়, এতে প্রশাসনের কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে আসবে। অধিকারের তথ্য অনুযায়ী, ৯ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৬৫ জন নিহত এবং ১১ হাজার ৩০২ জন আহত হয়েছেন।
বিএসএফের মানবাধিকার লঙ্ঘন
অধিকারের মতে, ৯ মাসে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে বিস্তর। এ সময়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ৪৯ বাংলাদেশীকে হত্যা করে। তাদের ১৪ জনকে নির্যাতন এবং ৩৫ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এই সময়ে ৬১ জন বিএসএফের হাতে ও ১০ জন ভারতীয় অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর হাতে আহত হয়েছেন। বিএসএফের হাতে আহত এই ৬১ জনের মধ্যে ২৯ জন নির্যাতিত এবং ৩২ জন গুলিতে আহত হয়েছেন। এই সময়কালে ২৫ বাংলাদেশী বিএসএফের হাতে অপহৃত হয়েছেন। এছাড়া সীমান্ত এলাকায় ২ ব্যক্তি নিখোঁজ, ১টি লুটের ঘটনা এবং ৫ জন হিন্দিভাষী ভারতীয় মুসলিম নাগরিককে বাংলাদেশে পুশইন করা হয়েছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা
সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে অধিকার বলেছে, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশে ১ হাজার ৫৮৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় রিপোর্টে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। রিপোর্ট মতে, জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসে ধর্ষণের ব্যাপক ঘটনা ঘটেছে। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর ৯ মাসে ২৯৭ নারী যৌতুক সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
নিখোঁজ ও গুম হত্যা
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটকের পর নিখোঁজ ও গুম হওয়ার ঘটনায় অধিকার উদ্বিগ্ন। ৯ মাসে নয় ব্যক্তি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিখোঁজ হয়েছেন। নিখোঁজ ব্যক্তিদের দ্রুত উদ্ধার এবং গুম হওয়ার ব্যাপারে সরকারের ব্যাখ্যা দাবি করেছে অধিকার।
অধিকারের সুপারিশ
অধিকার ১৮ দফা সুপারিশ দিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে নিরপেক্ষ তদন্ত, রিমান্ড ও অন্তরীণ অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদকালে নির্যাতন বন্ধ করা, সংবাদ মাধ্যমের হস্তক্ষেপ ও সাংবাদিক নির্যাতন বন্ধ করা, সন্ত্রাস দমন আইন ২০০৯ বাতিল করা, রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকদের ওপর দমননীতি পরিহার, বিএসএফের অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং গুলি ও হত্যা ্বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া, নারী নির্যাতন বন্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ, সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করা, বিডিআর জওয়ানদের বিচারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/10/02/46640
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment