Tuesday, 17 August 2010

ট্রাইব্যুনালের বৈধতা নিয়ে রিটের শুনানি : ট্রাইব্যুনাল আইন সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী

স্টাফ রিপোর্টার
যুদ্ধাপরাধের বিচারে সংবিধানের প্রথম সংশোধনী এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট আবেদনের শুনানি রোববার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর কারাবন্দি দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং আবদুল কাদের মোল্লার এ সংক্রান্ত রিট আবেদনের আংশিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট গতকাল এ আদেশ দেন। বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহাব মিঞা এবং বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চে গতকাল এ শনানি শুরু হয়।
শুনানিতে রিটকারীর পক্ষে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আইন প্রণয়নের আগে ১৯৭৩ সালে বিল উত্থাপন করা হলে সংসদে বিতর্ক হয়। সংসদের আলোচনায় বলা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিহ্নিত ১৯৫ সদস্যের যুদ্ধাপরাধের বিচার করা হবে। ওই সময় সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্দেশ্যে কমিশন গঠন করে ১৯৫ পাকিস্তানি সেনাসদস্যকে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো চারটি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় চিহ্নিত করে। তাদের বিচারের জন্যই ওই বছরের ১৫ জুলাই সংবিধানের প্রথম সংশোধনী আনা হয়। সংশোধনীর পাঁচ দিন পর প্রণীত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন। এর একটাই উদ্দেশ্য ছিল, ১৯৫ জন চিহ্নিত পাকিস্তানি সেনাসদস্যের বিচার করা। যেহেতু তারা বাংলাদেশের নয়, পাকিস্তানের নাগরিক তাদের এজন্য মৌলিক অধিকার বঞ্চিত করা হয়। কিন্তু চিহ্নিত ওই ১৯৫ পাকিস্তানি সেনাসদস্যের বিচার বাদ দিয়ে ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে কিছু সংশোধন করে যে কোনো ব্যক্তির বিচার এবং শাস্তির বিধান জুড়ে দেয়া হয়েছে, যা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী।
তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাইয়ের প্রথম সংশোধনীর ৪৭ ও ৪৭(ক) ৩ অনুচ্ছেদে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সশস্ত্র বাহিনী, সহায়ক বাহিনী বা যুদ্ধবন্দিকে দণ্ড দেয়ার কোনো আইন সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্য হলেও বাতিল হবে না বলে উল্লেখ রয়েছে। এসব অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার প্রযোজ্য হবে না বলেও উল্লেখ রয়েছে। এটা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করা যায় না বলেও সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে বলেছেন সুপ্রিমকোর্ট। অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের বিষয়ে কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ না করতে পারার বিধানের মাধ্যমে হাইকোর্টের এখতিয়ারকে খর্ব করা হয়েছে। ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩ সংশোধন করা হয়। কিন্তু এ সংশোধনীর আলোকে ১৯৭১ সালের অপরাধের বিচার করা হচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী বলবত্ আইনে অপরাধের বিচার করতে হবে। কোনো আইনের ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দেয়া যাবে না। কিন্তু এক্ষেত্রে সংশোধনের পরও আইনের ভূতাপেক্ষতা দিয়ে আগের ঘটনার বিচার করা হচ্ছে। এ আইনের ৩(১) ধারায় প্রতিরক্ষা বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, সহযোগী বাহিনী বা যুদ্ধবন্দি এবং যে কোনো ব্যক্তির বিচারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সংবিধানে যে কোনো ব্যক্তির বিচারের কথা বলা হয়নি। ৬(২) ধারা অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি বা বিচারপতি হওয়ার যোগ্য ব্যক্তি ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হবেন। ৬(৮) ধারা অনুযায়ী এ ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বা সদস্যদের নিয়োগ চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এর মাধ্যমে হাইকোর্টের জুডিশিয়াল রিভিউর ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। ১৯(১) ধারা অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইন প্রযোজ্য হবে না। বই, ম্যাগাজিন, প্রকাশিত সংবাদ ইত্যাদি সাক্ষ্য হিসেবে আদালত গ্রহণ করতে পারবেন। ১৯(৩) ধারা অনুযায়ী কোনো প্রমাণ ছাড়া ট্রাইব্যুনাল প্রচলিত বা সাধারণভাবে জানা তথ্য গ্রহণ করতে পারবে। এর মাধ্যমে অভিযুক্তদের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার খর্ব করা হয়েছে। ২০(২) ধারায় মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড দেয়ার জন্য অপরাধের মাত্রার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। ফলে কোন অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া যাবে তা নিশ্চিত নয়। এছাড়া ২৩ ধারায় বলা হয়েছে, এ বিচারের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি প্রযোজ্য হবে না। অথচ ট্রাইব্যুনাল একটি ফৌজদারি আদালত। রিট আবেদনে এ বিধানগুলোকে সংবিধানের ৯৪, ৯৯ ও ১৪৭(৩) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী দাবি করা হয় এবং বিধানগুলোকে অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণার আবেদন জানানো হয়।
ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক আরও বলেন, রিট আবেদনকারীদের যুদ্ধাপরাধের মামলার অভিযোগে নয়, অন্য আইনে গ্রেফতারের পর দুটি মামলায় আটক রাখা হয়েছে। ’৭৩ সালের আইনটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চিহ্নিত ১৯৫ সদস্যের জন্য প্রণয়ন করা হলেও রিট আবেদনকারীদের ওই আইনে আটক রাখায় তারা সংক্ষুব্ধ হয়ে সংবিধানের প্রথম সংশোধনী ও ট্রাইব্যুনালের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেছেন।
শুনানির সময় রিট আবেদনকারীর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার মো. বদরুদ্দোজা বাদল, অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন এমপি, ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার, অ্যাডভোকেট ফরিদ উদ্দিন খান, অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার বেলায়েত হোসেন, ব্যারিস্টার মাসুদ আহমেদ সাঈদ, ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিক, ব্যারিস্টার ইমরান এ সিদ্দিক, ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাশেম প্রমুখ। সরকার পক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এমকে রহমান।
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/08/18/39745

No comments:

Post a Comment