নাছির উদ্দিন শোয়েব
ডিবি কার্যালয়ে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে দুটি গোয়েন্দা সংস্থার ৮ সদস্য অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পাঁচ দিনের রিমান্ডে ডিবি কর্মকর্তারা তাকে তেমন কোনো জিজ্ঞাসাবাদ না করলেও গভীর রাতে অন্য সংস্থার লোকজন এসে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। নাকে ঘুষি দিয়ে তাকে রক্তাক্ত করা হয়। বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়। পায়ের নিচে শক্ত লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়। শরীরে ইনজেকশন পুশ করা হয়। এ ছাড়াও তাকে বিভিন্ন হুমকি দিয়ে মানসিকভাবে দুর্বল করার চেষ্টা করেছে তারা। একপর্যায়ে তাকে এই বলে হুমকি দেয়া হয়েছে, ‘ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমকে পেটের নাড়িভুঁড়ি বের করে যেভাবে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে, তোর পরিণতিও ঠিক একই রকম হবে।’ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী নাকের রক্ত যে টিস্যু দিয়ে মুছেছেন সেই টিস্যুটি তিনি তার পরিবারের কাছে সরবরাহ করেন। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পারিবারিক সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
২৬ জুন মগবাজারে গাড়ি পোড়ানো মামলায় পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গতকাল সিএমএম আদালতে হাজির করা হয়। আদালতের অনুমতি নিয়ে দুপুরে পরিবারের তিন সদস্য এবং তিন আইনজীবী তার সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। সাক্ষাত্কারীরা হচ্ছেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী, বড় ছেলে ফাইয়াজ কাদের চৌধুরী, ছোট ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী, আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার ডালিয়া চৌধুরী (বড় ছেলের স্ত্রী) এবং অ্যাডভোকেট আবু জাফর মানিক। চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে তারা আদালতের হাজতখানায় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। এসময় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে তারা কোনো খাবার সরবরাহ করতে পারেননি। ফল, বিস্কুট ও পারিবারিকভাবে কিছু খাবার নিয়ে গেলেও পুলিশ তা সরবরাহ করতে দেয়নি বলে জানা গেছে।
এদিকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিচারকাজ পর্যবেক্ষণে দুপুরে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের দুই কূটনীতিক আদালতে যান। দুপুর ১টায় মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা পোলিয়ার ফরেস্ট গ্রাহাম ও সহকারী রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ লুবেন চৌধুরী মাসুম আদালতে পৌঁছান। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবীর মাধ্যমে তারা আদালতের অনুমতি চাইলেও তাদের হাজতখানায় বিএনপি নেতার সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়নি। সূত্র জানায়, ওই দুই মার্কিন কূটনৈতিক স্বেচ্ছায় বিচারকাজ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েছিলেন। সাক্ষাতের অনুমতি না পেয়ে পরিবারের কাছ থেকে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রিমান্ড, নির্যাতন এবং তার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। এর প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট দফতরে উপস্থাপন করা হবে বলে তারা পরিবারকে জানিয়েছেন।
পারিবারিক সূত্র জানায়, গত ১৬ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী থেকে গ্রেফতার হওয়ার পর গতকালই প্রথম পরিবারের লোকজনের সাক্ষাত্ পেলেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। বেলা আড়াইটার দিকে আদালতের হাজতখানায় পরিবারের সদস্যদের কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। এসময় এক আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। গ্রেফতারের পর ৬ দিনে তার জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া দুঃসহ দিনগুলোর কথা তুলে ধরেন তিনি। ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মানসিক অবস্থা এখনও আগের মতোই আছে। তিনি ভেঙে পড়েননি। তিনি স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে এবং পরিবারের উদ্দেশে বলেছেন, তার মনোবল অটুট আছে, থাকবে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তাদের বলেছেন, ‘আমাকে সাফ করে দেয়া এতটা সহজ নয়। দল যদি পাশে থাকে ওরা আমার কিছুই করতে পারবে না।’ এসময় পরিবারের সদস্যরা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ম্যাডামের কাছে (বিরোধীদলীয় নেতা) আপনার সব খবর আছে। আপনাকে গ্রেফতার এবং নির্যাতনের বিষয় নিয়ে দলীয় পক্ষ থেকে কর্মসূচি চলছে। সাধারণ মানুষ সরকারের এসব বিষয় ভালোভাবে নেয়নি বলেও তাকে অবহিত করা হয়েছে। পরিবারের কাছ থেকে এসব কথা শুনে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মনোবল আরও দৃঢ় হয়েছে বলে জানা যায়।
পারিবারিক সূত্র জানায়, হাজতখানায় ৩০ মিনিটের সাক্ষাতে বেশিরভাগ সময়েই তিনি তার ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। এসময় তার পা ফোলা এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। তিনি বলেছেন, গ্রেফতারের পরপরই আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কিছু সদস্য তার ওপর নির্যাতন শুরু করে। এরপর ক্যান্টনমেন্ট থানায় নিয়ে পায়ের এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত করা হয়। শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্লেড দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। এরপর ডিবি কার্যালয়ে রিমান্ডে নিয়েও তার ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। তিনি বলেন, ৫ দিনের রিমান্ডে থাকাকালে ডিবির কর্মকর্তারা তার ওপর নির্যাতন চালায়নি। তদন্ত কর্মকর্তা তার কাছে তেমন কোনো বিষয় জানতেও চায়নি। তবে রাতে দুটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন মাঝেমধ্যেই ডিবি কার্যালয়ে এসে তার ওপর নির্যাতন করেছে। কখনও চোখ বেঁধে, আবার চোখ খোলা রেখে নির্যাতন করেছে। তাদের সংখ্যা হবে ৭-৮ জন। তারা বিভিন্নভাবে হুমকি দিয়ে আমাকে মানসিকভাবে দুর্বল করার চেষ্টা করে। শরীরে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়েছে। ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে। নির্যাতনে আমার চোখ দিয়ে পানি বের না হওয়ায় তারা অবাক হয়ে বলে, তুই তো কঠিন মানুষ। চোখে এক ফোঁটা পানিও নেই? এরপর তারা হুমকি দিয়ে বলেছে, তোর পরিণতি কী হবে জানি না। ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমকে যেভাবে পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে তোর পরিণতিও হবে সেরকম। এসব কথা শুনে মাঝেমধ্যে ঘাবড়ে গেলেও মানসিকভাবে তাকে দুর্বল করতে পারেনি। এভাবে প্রতিরাতেই বাইরে থেকে লোকজন এসে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন চালিয়েছে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী পরিবারের কাছে আরও বলেন, বাইরে থেকে ওই লোকজন যখনই আসত ডিবির কর্মকর্তারা তখন ওই কক্ষ থেকে চলে যেতেন।
No comments:
Post a Comment