Sunday, 18 July 2010

অধিকার-এর রিপোর্ট : নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছেই

ইলিয়াস খান
দেশের নিরাপত্তা হেফাজতে এখন মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলেছে। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, গত ছয় মাসে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে নিহত ৬১ জনের মধ্যে ১৩ জন মারা গেছেন নিরাপত্তা হেফাজতে থাকাকালে। এছাড়া অর্থের জন্য সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ভূমি দখল, লুটপাট, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজির ঘটনার সঙ্গে র্যাব-পুলিশের সদস্যরা জড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে বলে মানবাধিকার সংগঠন প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। এতে সারাদেশে মারাত্মক ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার জানিয়েছে, গত ছয় মাসে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে ৬১ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে র্যাবের হাতে ২৯ জন, পুলিশের হাতে ২৫ জন এবং র্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযানে ৪ জন মারা যান। এই ৬১ জনের মধ্যে ১৩ জন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে থাকাকালে মারা গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ সময়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ক্রসফায়ারে ৫২ জন মারা গেছেন। এর মধ্যে র্যাবের হাতে ২৭ জন, পুলিশের হাতে ১৮ জন, র্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযানে ৪ জন এবং ৩ জন র্যাব- কোস্টগার্ডের যৌথ অভিযানে নিহত হয়েছেন। এসময় মোট ১২ জন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নির্যাতনে নিহত হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে র্যাব হেফাজতে ২ জন এবং পুলিশের নির্যাতনে ১০ জন নিহত হয়েছেন। গত ৬ মাসে জেলহাজতেও ৩৮ জন মারা যান। এদের মধ্যে ২ জন মারা যান কোর্ট হাজতে এবং ২ জন র্যাব হেফাজতে। একটি মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যানুযায়ী, এ সরকারের গত ৬ মাসে ৬৬ জন এবং গত ১৭ মাসে ১৩৭ জনকে র্যাব-পুলিশ হত্যা করেছে। রাজধানীতেও সম্প্রতি ৩ জনকে ধরে নিয়ে পুলিশ হত্যা করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ায় দেশের মানুষের জীবন ও সম্পদ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এদিকে গত দেড় বছরে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা দেশব্যাপী সংঘর্ষ ও সহিংসতা ঘটালেও পুলিশ-র্যাব নীরব ভূমিকা পালন করে। উচ্ছৃঙ্খল ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও আটকের খবর তেমন পাওয়া যায় না।
অভিযোগ আছে যে, সম্প্রতি রাজধানীর দারুস সালাম এলাকায় শিশুপুত্রের সামনেই মজিবর রহমান (৪৫) নামের এক ব্যক্তিকে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে আটক করে পুলিশ। পরদিন তার লাশ তুরাগ নদীতে পাওয়া যায়। এর আগে গুলশানের বাসা থেকে ব্যবসায়ী মিজানুর রহমানকে (৪২) আটক করে পুলিশ। পরিবারের অভিযোগ, থানা হেফাজতে দু’দিন রাখার পর ঘুষ না দেয়ায় পুলিশ তাকে হত্যা করেছে। অন্যদিকে ছিনতাইকালে পুলিশের হাতে তিনি নিহত হন বলে দাবি করেছে গুলশান থানা পুলিশ। এছাড়া রমনা থানা হেফাজতে অটোরিকশা চালক বাবুল গাজী (৪০) নিহত হন। তার স্ত্রী সুভা আক্তার অভিযোগ করেন, ঘুষ না পেয়ে থানার এক এসআই তাকে পিটিয়ে মেরেছে। এর আগে গত ৯ মার্চ রমনা থানায় গাড়ি চুরির মামলায় আটক জাকির হোসেন (৪৫) মারা যান।
শুধু হত্যাকাণ্ডই নয়, আরও নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে র্যাব-পুলিশ। গত ১৯ ডিসেম্বর ৩টি চোরাই গাড়িসহ পুলিশের সিলেট ডিআইজি অফিসের হাবিলদার তাজুল ইসলামকে সিলেট থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তিনি নজরুল ইসলাম নাম ব্যবহার করে নিজেকে সার্জেন্ট পরিচয় দিয়ে চোরাই গাড়ি বিক্রি করতেন। এর আগে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর ১৬ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের সময় আদাবর থানার এএসআই মাইনুল হক গ্রেফতার হন। তার সঙ্গে থাকা অন্য দুই পুলিশ সদস্য পালিয়ে যান। পালিয়ে যাওয়া পুলিশ সদস্যরা হলেন রাজধানীর কোতোয়ালি থানার এসআই রওশন জামান ও ঢাকা ডিবির কনস্টেবল সাজু। গত বছরের ৭ ডিসেম্বর মতিঝিলে পুলিশ পরিচয়ে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পৌনে ১২ লাখ টাকা ছিনতাই হয়। দুপুর ২টার দিকে মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের কাছে শত শত পথচারীর সামনে এ ঘটনা ঘটে। বাড্ডা থানার এসআই তানভীর আহম্মদ ও এএসআই মিজান গত ১১ নভেম্বর রাতে গফুর হাওলাদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধাকে তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে পাঁচ হাজার টাকা আদায় করে ছেড়ে দেন। পরে তিনি এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরের সিকিউরিটি সেলে লিখিত অভিযোগ করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা গফুর হাওলাদারের ছেলে রাসেলকে ধরে থানায় নিয়ে গিয়ে নির্যাতন চালায়। গত ২৩ নভেম্বর রাজধানীর দারুস সালাম থানার এসআই হেকমত আলী স্থানীয় ব্যবসায়ী মেহেদী হাসানকে তার বাসা থেকে ধরে দু’লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা না দেয়ায় তাকে একটি হত্যা মামলায় পরদিন আদালতে হাজির করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। পরে মেহেদির স্ত্রী নার্গিস এসআই হেকমত আলী ও ওসি মোস্তাক আহম্মেদকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে তার স্বামীকে পুলিশের হয়রানি থেকে রক্ষা করেন।
র্যাব-পুলিশ কর্তৃক আটকের পর নিখোঁজ বা গুপ্তহত্যা নিয়ে সারাদেশের সর্বমহলে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে আটকের পর অনেকের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না এবং পরে কারও কারও লাশ উদ্ধার হচ্ছে। ভিকটিমদের পরিবারগুলো দাবি করেছে যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাই তাদের আটক করে নিয়ে গেছে। পরে অনেকের লাশও উদ্ধার হয়েছে। বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম র্যাব কর্তৃক গত ২৫ জুন আটকের পর হতে নিখোঁজ রয়েছেন। তার পরিবার থেকে সরকারসহ নানা মহলে যোগাযোগ করেও কোনো খবর আজও পাওয়া যায়নি। গত ২৭ এপ্রিল মিজানুর রহমান সুমন নামের এক ব্যবসায়ীকে সাদা পোশাকধারী র্যাব সদস্যরা গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করে ঢাকায় নিয়ে আসে। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। সুমনের স্ত্রী সুরভী আক্তার গত ৩০ এপ্রিল ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, র্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে র্যাব কার্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করেও সুমনের কোনো হদিস পাননি তারা। গত ১৯ মার্চ র্যাব-৫-এর সদস্যরা ঠাকুরগাঁও সালন্দার নওলাপাড়ার কাঠ ব্যবসায়ী মো. আকবর আলী সরদার (২৮) এবং একই গ্রামের বিপিন চন্দ্র সরকারকে (৩৬) সালন্দার বিশ্ব ইসলামী মিশন মসজিদের সামনের রাস্তা থেকে আটক করে নিয়ে যায়। ২০ মার্চ বিপিন সরকারকে র্যাব ছেড়ে দিলেও আকবরের কোনো খোঁজ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আকবরের পরিবারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে ঠাকুরগাঁও থানায় জিডি বা মামলা করতে চাইলে থানা পুলিশ এর কোনোটাই গ্রহণ করেনি। পরে আকবরের পরিবার ঠাকুরগাঁও পুলিশ সুপারের মাধ্যমে র্যাব-৫-এর কাছে আকবরের খোঁজ করলে তারা আকবরের আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি র্যাব সদস্য পরিচয়ে কতিপয় ব্যক্তি গাজীপুরের কাপাসিয়ার ফল বিক্রেতা মো. সেলিমকে ধরে নিয়ে যায়। তার পরিবারের অভিযোগ, র্যাব-৪-এর একটি দল সেলিমকে তার দু’বন্ধু মইনুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আলীসহ গ্রেফতার করে। মইনুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আলীকে গ্রেফতারের বিষয়টি র্যাব-৪ স্বীকার করলেও মো. সেলিমের কথা অস্বীকার করে। র্যাব মইনুল ইসলামকে ক্যান্টনমেন্ট থানাধীন মানিকদী এলাকার ছাত্রলীগ নেতা ফারুক হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থানায় সোপর্দ করে এবং মোহাম্মদ আলীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়। কিন্তু ঘটনার পর থেকে সেলিম নিখোঁজ রয়েছেন।
পুলিশ হেফাজতে অব্যাহতভাবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছেই। প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনায়ই নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পুলিশ তাদের হত্যা করেছে। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই তা পুলিশ অস্বীকার করে আসছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার একেএম শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, পত্রিকায় যা লেখা হয়, তা বানোয়াটও হতে পারে। আর পুলিশ কাউকে ধরলেই সে ভালো হয়ে যায়। পুলিশ কর্তৃক শেষ ৩টি হত্যার অভিযোগ সম্পর্কে পুলিশ কমিশনার সাংবাদিকদের বলেছেন, এ তিনটি ঘটনাই বিচ্ছিন্ন। তবে এতে পুলিশের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কিনা, তা তদন্ত করে দেখা হবে।
এদিকে প্রতিটি ঘটনায় পুলিশ তদন্ত কমিটি গঠন করলেও এ কমিটির ওপর আস্থা নেই নিহতদের স্বজনদের। মৃত মজিবরের ভাই বলেছেন, পুলিশি তদন্তে আস্থা নেই। পুলিশ হেফাজতে হাজতির মৃত্যুর ঘটনায় সুরাহা চেয়ে সম্প্রতি বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চে রিট আবেদন করে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ-এর পক্ষে অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান ও বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এলিনা খান। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে পুলিশ হেফাজতে হাজতির মৃত্যুর ঘটনায় সরকারের প্রতি রুল জারি করেন হাইকোর্ট। হাজতির মৃত্যুর ঘটনায় অপরাধীদের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হবে না এবং পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু প্রতিরোধে কেন পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হবে না মর্মে স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের আইজি, ডিএমপি পুলিশ কমিশনারসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে তিন সপ্তাহের রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট এবং এ সমস্যার সমাধান ও সর্বজনীন রায় প্রদানের লক্ষ্যে আদালত ১১ আইনজীবীকে এমিকাস কিউরিও নিয়োগ দিয়েছেন। এরা হলেন : ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার ফিদা এম কামাল, ড. এম জহির, সিনিয়র অ্যাডভোকেট মাহমুদুল ইসলাম, আবদুল বাছেত মজুমদার, আবদুল মতিন খসরু, আনিসুল হক ও ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন।

http://www.amardeshonline.com/pages/details/2010/07/19/35308

No comments:

Post a Comment