আখাউড়া ও সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি | তারিখ: ২৪-০৬-২০১০
সমাবেশ করে প্রথম আলোর ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি ওয়ালিদ সিকদারকে মারার হুমকি দেওয়া হয়েছে। সমাবেশ শেষে ‘জেএমবি’ আরাফাতের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অর্ধশত নেতা-কর্মী ওয়ালিদ সিকদারের বাসায় গিয়ে তাঁকে খুঁজতে থাকেন। ওয়ালিদ তখন বাসায় ছিলেন না। তাঁরা পরে শহরের বিভিন্ন স্থানে তাঁর খোঁজে তল্লাশি চালান।
‘সাংসদের আপত্তিতে অতিথি করায়...’ শিরোনামে গত মঙ্গলবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদের প্রতিক্রিয়ায় এ ঘটনা ঘটানো হয়। সোমবার সাংসদের উপস্থিতিতে জেলা আইনজীবী সমিতির সম্প্রসারিত ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর ভেঙে ফেলেন ছাত্র ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক একান্ত সচিব রবিউল আলম ওবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীকে বিশেষ অতিথি করায় সাংসদ আপত্তি করেন এবং ক্ষুব্ধ হন। পরে নতুন ভিত্তিপ্রস্তর বানানো হয় এবং মঙ্গলবার আইন প্রতিমন্ত্রী ভবনের কাজ উদ্বোধন করেন।
ভিত্তিপ্রস্তর ভাঙার খবর প্রকাশের পর ওই দিনই স্থানীয় সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লুৎফুল হাই প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে ফোন করে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। সাংসদ বলেন, ‘তুই আমার কিছু পাইলেই পত্রিকায় নিউজ করিস। অথচ কয়েক দিন আগে শহরে বিএমএর সাধারণ সম্পাদক ও যুবলীগের সহসভাপতি বাবলুর (আশিকুল আলম) মধ্যে অনেক ঘটনা ঘটছে, পুলিশ এই ঘটনা সামলাতে গুলিবর্ষণ করেছে। এই সব নিউজ তুই পিটা খাওয়ার ভয়ে পত্রিকায় না করে অনলাইনে করেছিস। আর আমার বিরুদ্ধে কিছু হলে পত্রিকায় নিউজ করিস।’ তিনি প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে দেখে নেওয়ারও হুমকি দেন। তবে তিনি বা তাঁর পক্ষে কেউ সংবাদের কোনো লিখিত প্রতিবাদ করেননি।
এরপর গতকাল আওয়ামী লীগ এবং ছাত্র ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা মাবববন্ধন করেন, পত্রিকার কপিতে আগুন দেন এবং সমাবেশ করেন। সমাবেশে জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম ফেরদৌস ঘোষণা দেন, ‘রবিনকে (ওয়ালিদ সিকদারের ডাক নাম) যেখানে পাওয়া যাবে, সেখানেই পেটানো হবে।’
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আমানুল হক ওরফে সেন্টুর সভাপতিত্বে পৌর আধুনিক সুপার মার্কেটের সামনে সমাবেশে জেলা যুবলীগের সভাপতি মাহবুবুল আলম খোকন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রথম আলোকে অবাঞ্ছিত করার হুমকি দেন।
আমানুল হক বলেন, ‘প্রথম আলোয় যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তার প্রতিবাদে যে মানববন্ধন হয়েছে, তাতে অন্য বক্তারা সবই বলেছেন। আমিও বলতে চাই, এমন সংবাদ প্রকাশ করলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রথম আলোকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।’
এর আগে শহরের তোফায়েল আজম (টিএ রোড) সড়কে ১৭ আগস্ট বোমা হামলা মামলার অন্যতম আসামি শেখ মো. আরাফাত ওরফে জেএমবি আরাফাত, শহরের কান্দিপাড়ার ব্যবসায়ী শাহীন খাঁ হত্যা মামলার আসামি মো. আল-আমিনের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা প্রথম আলোর কপিতে আগুন দেন। এ সময় প্রথম আলোর প্রতিনিধির চামড়া তুলে নেওয়া হবে বলে স্লোগান দেওয়া হয়।
জেলা আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ১২ মে প্রথম আলোয় ‘দখলের কবলে মেঘনা’ শিরোনামে একটি সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়। এর পর থেকেই সাংসদ লুৎফুল হাই প্রথম আলোর ওপর ক্ষিপ্ত হন। মঙ্গলবার ‘সাংসদের আপত্তিতে অতিথি করায়...’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হলে তিনি প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে ফোন করে হুমকি দেন।
সংবাদটি সঠিক ছিল বলে মন্তব্য করে জেলার প্রবীণ আইনজীবী ও আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সভাপতি হামিদুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে আওয়ামী লীগের যা কর্মকাণ্ড, তাতে আমি যে আওয়ামী লীগের একজন, তা বলতে ইচ্ছে করে না।’ তিনি প্রথম আলোকে সব প্রতিকূলতার মধ্যেও সত্য সংবাদ প্রকাশ করার অনুরোধ করেন।
জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জেলা জাতীয় পার্টির সহসভাপতি হারুনুর রশিদ খান বলেন, ‘প্রথম আলোয় মঙ্গলবার প্রকাশিত সংবাদটি মার্জিত, বস্তুনিষ্ঠ এবং শতভাগ সত্য ছিল। সোমবার ঘটনা ঘটার পর সাংসদ লুৎফুল হাই সাচ্চুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “আপনার উপস্থিতিতে এমন ঘটনা কী করে ঘটল?” তিনি এর কোনো উত্তর দেননি।’
সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ নাজমুল হোসেন বলেন, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা সাংসদের সামনেই ফলকটি ভাঙেন। এ নিয়ে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করার কোনো সুযোগ নেই। যা ঘটেছে, শত শত আইনজীবীর সামনেই ঘটেছে।
জাতীয় আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা জাসদের (ইনু) সভাপতি আক্তার হোসেন সাঈদ বলেন, সত্য সংবাদ সবাই মেনে নিতে পারেন না। তাই তাঁরা এসব করছেন।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি সাবেক পিপি শফিকুল ইসলাম বলেন, শত শত আইনজীবীর সামনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির নির্মাণাধীন সম্প্রসারিত ভবনের ভিত্তিপ্রস্তরটি যাঁরা ভেঙেছেন, তাঁরা সাংসদের সঙ্গে এসেছেন, তাঁর সামনেই ভেঙেছেন, তাঁর সঙ্গেই আইনজীবী সমিতিতে বসেছিলেন এবং তাঁর সঙ্গেই আদালত এলাকা ত্যাগ করেন। তিনি বলেন, ‘আশা করি, প্রথম আলো সত্য সংবাদ প্রকাশের পথ থেকে সরে যাবে না।’
গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির জেলা সম্পাদক কাজী মাসুদ আহম্মেদ বলেন, ‘ভিত্তিপ্রস্তরটি যাঁরা ভেঙেছেন, তাঁরা লুকিয়ে-ছাপিয়ে ভাঙেননি। আর সংবাদটি বেশ কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকেও ছাপা হয়েছিল।’
ক্ষোভ ও নিন্দা: জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হক খান (বীর প্রতীক) প্রথম আলোর প্রতিনিধিকে মারতে খোঁজ করা এবং পত্রিকা পোড়ানোর ঘটনায় নিন্দা জানান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবও গত রাতে জরুরি সভা করে নিন্দা জানায়। বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আহ্বায়ক দীপক চৌধুরী এ ঘটনায় ক্ষোভ ও নিন্দা জানান।
source:http://www.prothom-alo.com/detail/date/2010-06-24/news/73371
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment