স্টাফ রিপোর্টার
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কর্মসূচির দক্ষিণ এশিয়া প্রধান আব্বাস ফয়েজ বলেছেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। পরিস্থিতি এত ভয়াবহ যে, এখানে আজ মানবাধিকার কর্মীদেরও মানবাধিকার রক্ষা হচ্ছে না।
সাতক্ষীরায় সন্ত্রাসীদের হাতে শম্পা গোস্বামী নামের এক মানবাধিকার কর্মী লাঞ্ছনার ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশে এসে গতকাল সাংবাদিকদের কাছে তিনি এমনই মন্তব্য করেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবে অধিকার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি শম্পা লাঞ্ছনার ঘটনায় দায়ের করা মামলা তদন্তে পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, একজন মানবাধিকার কর্মী সন্ত্রাসীদের হাতে লাঞ্ছিত হলেও স্থানীয় প্রশাসন প্রথমে মামলাটি নিতে রাজি হয়নি। পরে মামলাটি রেকর্ড করলেও এ মামলার আসামিরা শম্পা গোস্বামীকে হুমকি দিচ্ছে। এমনকি তিনি যে স্কুলে চাকরি করেন সেখানেও তাকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। তাকে চাকরিচ্যুত করার চেষ্টা হচ্ছে। চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তিনি।
আব্বাস ফয়েজ বলেন, শম্পা লাঞ্ছনার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে সরকার কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও অধিকার তা মনিটরিং করবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সরকারগুলো মানবাধিকার রক্ষার কথা মুখে বললেও বাস্তবায়ন করে না। সাতক্ষীরা, খুলনা ও যশোর অঞ্চলে সাংবাদিক শামছুর রহমান, হুমায়ুন কবীর বালু, মানিক সাহা, স ম আলাউদ্দিন, হারুন-অর-রশিদসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। অসংখ্য সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সন্ত্রাসী-গডফাদাররা এসব সাংবাদিক নির্যাতন ও হত্যার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই সাংবাদিক হত্যার বিচার করেনি। মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করতে গিয়ে আজ সাতক্ষীরার শম্পা গোস্বামীকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে অধিকারের প্রেসিডেন্ট প্রফেসর সি আর আবরার, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কর্মসূচির সহকারী টিম মলি নিয়াকস, অধিকারের প্রোগ্রাম অফিসার রুমানা আমান বক্তব্য রাখেন।
ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন তুলে ধরে রুমানা আমান সাংবাদিকদের জানান, খুলনা জেলার পাইকগাছায় গণধর্ষণের শিকার এক মহিলার ঘটনা তদন্তে গিয়ে শম্পা গোস্বামীর সঙ্গে সুশান্ত করের পরিচয় হয়। সুশান্ত নিজেকে একজন বন্ধকি ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেন। ধর্ষণের ভিকটিম প্রথমে এ ব্যাপারে কথা বলতে অস্বস্তিবোধ করেন। সুশান্তও এ বিষয়টি চেপে যেতে চাপ সৃষ্টি করেন। শম্পা গোস্বামী কারও কথায় কান না দিয়ে আইনের আশ্রয় নেয়ার জন্য ভিকটিমকে পরামর্শ দেন। ভিকটিম শম্পা গোস্বামীর মোবাইল নম্বরটি চেয়ে নেন। এ সময় সুশান্ত করও নম্বরটি টুকে নেন। শম্পা পরে জানতে পারেন, ভিকটিম ধর্ষকদের বিরুদ্ধে পাইকগাছা থানায় মামলা করেছেন। ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত সুশান্ত করের কয়েকজন আত্মীয়কেও আসামি করা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হন সুশান্ত। তিনি মামলাটি তুলে নেয়ার জন্য শম্পা গোস্বামীকে চাপ দেন। শম্পা এ বিষয়ে তার কিছুই করার নেই বলে জানান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সুশান্ত তাকে দেখে নেয়ার হুমকি দেন। গত ২৩ অক্টোবর দুপুরে অধিকার থেকে পাঠানো কিছু কাগজপত্র ডিসি অফিসে জমা দিতে যাওয়ার পথে সূচনা বেকারির সামনে প্রথমে ৪-৫ যুবক এসে শম্পা গোস্বামীকে উদ্দেশ করে কুরুচিপূর্ণ কথা বলতে থাকে। এর কয়েক মিনিট পর তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সুশান্ত ও সমীর দে। একপর্যায়ে পুলিশি সহায়তা নিতে শম্পা মোবাইল হাতে নিলে এক যুবক এসে ফোনটি ছিনিয়ে নেয় এবং তাকে একটি দোকানের ছাদে নিয়ে যায়। পরে একজন সাংবাদিক এসে তাকে উদ্ধার করেন। বিষয়টি থানাকে অবহিত করা হয়। ২৫ অক্টোবর সাতক্ষীরা সদর থানায় একটি মামলা করেন শম্পা। মামলার অন্যতম আসামি সমীর দে’কে ২৮ অক্টোবর পুলিশ গ্রেফতার করে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সুশান্ত কর ৩০ অক্টোবর শম্পা গোস্বামীকে মোবাইলে ফোন করে জানায়, সমীরের জামিনের ব্যবস্থা না করলে তাকে দেখে নেবে। সে সময় সে ভারত থেকে ফোন করেছে বলে জানায় ।
এ ঘটনার পর শম্পা গোস্বামী যে স্কুলে শিক্ষকতা করেন ওই স্কুল কর্তৃপক্ষ তার পাশে না দাঁড়িয়ে উল্টো চাকরিচ্যুতির হুমকি দেয়। ৩ নভেম্বর স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শাহাদাত হোসেন সভা ডাকেন। সভায় শম্পাকে ডেকে নিয়ে তিরস্কার করেন এবং কেন অধিকারের কাজে শহরে গেলেন, সেজন্য কৈফিয়ত তলব করেন। থানায় মামলা করায় বকাবকি করে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বলেন, সমীর আমার প্রতিবেশী ও রাজনৈতিক দলের কর্মী। আপনি কোন সাহসে তার বিরুদ্ধে মামলা করলেন। তিনি ঘটনা তদন্তে নিজেই একটি কমিটি গঠন করে বলেন, তদন্ত টিম আপনার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে আপনাকে চাকরিচ্যুত করা হবে। এরপর তাকে তিরস্কার করে মিটিং থেকে বের করে দেন। ওইদিনই সমীর দে জামিনে মুক্তি পেয়ে এলাকার বখাটেদের সঙ্গে নিয়ে শম্পার বিরুদ্ধে কুত্সা রটাতে থাকে এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের শম্পার ক্লাস বর্জন করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। ১১ নভেম্বর সমীর দে তার এক বন্ধুর মাধ্যমে মামলা তুলে না নিলে উচিত শিক্ষা দেবে বলে হুমকি দেয়।
প্রফেসর সি আর আবরার সাংবাদিকদের জানান, বর্তমানে শম্পা চরম নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি চাকরি থেকে বরখাস্তের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। আবরার শম্পা গোস্বামীর নিরাপত্তা ও লাঞ্ছনাকারীদের বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানান।
No comments:
Post a Comment