আলাউদ্দিন আরিফ
দেশে মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বেপরোয়াভাবে। এক্ষেত্রে ভেঙে গেছে অতীতের সব রেকর্ড। মানবিকতা নির্বাসনে। হরহামেশা চলছে নিষ্ঠুরতা আর বর্বরতা। শাসকগোষ্ঠীর আস্কারায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা পদদলিত করছে মানবিক অধিকারকে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের নজির অজস্র। পুলিশ সদর দফতরের রেকর্ড বলছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে খুন ১২টি। মানুষের হাতেই লাঞ্ছিত হচ্ছে বনি আদম। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে বাড়ছে উদ্বেগ, আতঙ্ক। হত্যা, অপহরণ, গুম, ক্রসফায়ার, হেফাজতে মৃত্যু, পিটিয়ে হত্যা, নির্যাতন, রাজনৈতিক অধিকার হরণ, পুলিশের বর্বর নির্যাতন, রিমান্ডে নির্যাতন, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সরকারবিরোধী নেতাকর্মীদের মামলায় ফাঁসানো আর নিজেদের মামলা প্রত্যাহার, নারীর প্রতি চরম সহিংসতা, ইভটিজিং, সভা-সমাবেশ ও মিছিলে হামলা-গ্রেফতার, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, দখল, পত্রপত্রিকার কণ্ঠরোধ, পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া, সম্পাদক ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারসহ মানবাধিকার
লঙ্ঘনের হেন অপরাধ নেই, যা এখন ঘটছে না।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে সংবেদনশীল মামলায় বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতাদের জড়াচ্ছে যথেচ্ছভাবে। রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে হাজির করা হচ্ছে আদালতে। ঠুনকো অজুহাতে গ্রেফতার করে বানোয়াট মামলায় রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন মামলা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। নাগরিক দুর্ভোগ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমনই যে, ঘরে বসেও নিরাপদ বোধ করছে না মানুষ।
মানবাধিকার কর্মী ও বিশিষ্টজনদের মতে, ‘মানবাধিকার’ এমন একটি সর্বজনীন বিষয়, যা কোনো দেশের ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ করা যায় না। মানবাধিকার জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সব দেশে, সব সমাজে, সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। এটি জাত মানে না, ধর্ম চেনে না, দেশ-কাল-পাত্রও চেনে না। এটা বিশ্বের সবার সর্বজনীন একটি সম্পদ।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের জন্মের পর থেকে প্রায় সব সরকারের সময়েই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই দেশজুড়ে শুরু হয় দখল, চাঁদাবাজি আর রাজনৈতিক সহিংসতা। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম ১৫ দিনেই রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছিল ১৫ জন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তাণ্ডব চালায় ছাত্রলীগ। শুরু হয় হাটবাজার, মাঠঘাট, বিল-বাঁওড় দখলের প্রতিযোগিতা। দখলবাজদের গ্রাসে পড়ে নিরীহ মানুষের জমি, বালিমহাল, কবরস্থান এবং পাবলিক টয়লেটও। পাল্লা দিয়ে চলে টেন্ডারবাজি। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর টেন্ডার নিয়ে রক্তাক্ত লড়াই চলে সরকার সমর্থকদের মধ্যে। এসব লড়াই ছিল ছাত্রলীগের নানা গ্রুপ; ছাত্রলীগ বনাম যুবলীগ অথবা যুবলীগ বনাম স্বেচ্ছাসেবক লীগের মধ্যে।
এই সরকারের অভিষেকের দু’মাসের মাথায় ৫৭ দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারসহ ৭৪ জনকে হত্যার মধ্য দিয়ে ঘটে ‘পিলখানা ট্র্যাজেডি’। বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) জওয়ানদের রিমান্ডে নিয়ে চলে নির্যাতন, প্রকৃত অপরাধীদের অনেকেই থেকে গেছে আড়ালে। জিজ্ঞাসাবাদকালে ২০০৯ সালেই নিহত হয় ৫১ জওয়ান। মহাজোটের শাসনের মাত্র দু’মাসের মাথায় এমন বিভীষিকা দেখে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল মন্তব্য করেছিল, ‘আগামী পাঁচ বছর দেশে শনির দশা বিরাজ করবে। কারণ শুরুটাই বলে দেয়, দিনটি কেমন যাবে।’ বাস্তবে ঘটছেও তাই।
২০০৯ সালে ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউয়ের (ইউপিআর) শুনানিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানোর কথা বলেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের ডজনখানেক মন্ত্রী, পুলিশের আইজি, র্যাবের ডিজিসহ অনেকেই ঘোষণা দেন। বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, গুলিবিনিময়সহ বিভিন্ন নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা চলছেই। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের রেকর্ডে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ৩৪৭টি। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে মারা গেছে ১৭২ জন। চলতি বছরের ৯ মাসে হেফাজতে নিহত হয়েছে ১১৫ জন। এই সময় গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার শতাধিক ব্যক্তি। চলতি বছরই ১৭ ব্যক্তিকে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা তুলে নেয়ার পর এখন পর্যন্ত তারা নিখোঁজ।
২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ৫৬৬ জন। আহত হয়েছেন ৪০ হাজার। পুলিশ সদর দফতরের রেকর্ড বলছে, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশে খুন হয়েছে ১০ হাজার ৭০টি, অর্থাত্ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১২টি। এর বাইরে রয়েছে ক্রসফায়ার, গুপ্তহত্যা, অপহরণ ও গুম। একই সময়ে দেশে ফৌজদারি অপরাধে মামলা হয়েছে ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৯৬১টি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশ ও সরকারি দল এসব মামলা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও বিরোধী দলকে দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজনৈতিক সহিংসতা, মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের আরেকটি উদাহরণ বিরোধীদের দমন। আন্দোলনে রাস্তায় নামলেই পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার, মোবাইল কোর্ট বসিয়ে তাত্ক্ষণিক শাস্তি, বেধড়ক লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল, ধরে নিয়ে নির্যাতন এবং ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের লেলিয়ে দিয়ে হামলা চালানো হচ্ছে। হরতালে মিছিল করায় গত ৭ জুলাই বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর বর্বর হামলা করে পুলিশ। গত ১২ জুনসহ বিভিন্ন সময়ের হরতালে মহিলা নেত্রী নূরে আলম সাফাসহ বয়োজ্যেষ্ঠ কর্মীদের ওপরও হামলা চালানো হয়। ২০১০ সালের ২৭ জুন বিরোধী দলের ডাকা প্রথম হরতালের দিনই মির্জা আব্বাসের বাড়িতে হামলা চালায় র্যাব। ওলামা-মাশায়েখদের হরতালে কাঁচপুর সানারপাড়সহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও সরকারি দলের ক্যাডারদের নৃশংস হামলা ও তাণ্ডব চলেছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর চারদলীয় জোটের ডাকা হরতালের দিন পিকেটার ও ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের কর্মচারী ইউসুফ আলীর বুকে পুলিশ বুটজুতা দিয়ে নির্যাতন চালায়। এই দৃশ্য দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের আরেকটি উদাহরণ গণপিটুনিতে মৃত্যু। অধিকারের রিপোর্ট থেকে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে দেশে ১২০ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে। গত ২৭ জুলাই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে ৬ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে কিশোর শামসুদ্দীন মিলনকে পুলিশ গাড়ি থেকে নামিয়ে সহিংস জনতার মধ্যে ছেড়ে দেয়। তাদের উপস্থিতিতেই জনতা কিশোরটিকে পিটিয়ে হত্যা করে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর মিলনের লাশ পুলিশই আবার তাদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। গত ১৭ জুলাই রাতে রাজধানীর আমিনবাজারে ডাকাত বানিয়ে গণপিটুনিতে ৬ ছাত্রকে মেরে ফেলা হয়। পুলিশের তদন্তেই তাদের দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ মেলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই ভূমিকা আইনের প্রতি মানুষের আস্থাকে দুর্বল করবে। দেশকে ঠেলে দেবে মারাত্মক নৈরাজ্যের দিকে।
এই সরকারের আড়াই বছরে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে নারীর প্রতি। শুধু বোরকা পরার কারণে পিরোজপুর, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে নিরীহ নারীদের হয়রানি করা হয়েছে। ইভটিজিং এখন এক ভয়াবহ ব্যাধি। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, তথা ক্ষমতাসীনদের আশ্রিতরা যৌন লালসা মেটানের জন্য নারীর প্রতি হামলে পড়ছে। তাদের হাতে ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে অসংখ্য নারী। অনেকে নিজের ইজ্জত বাঁচাতে আত্মহত্যা করেছে। মেয়ের ইজ্জত বাঁচাতে গিয়ে বাবা, স্ত্রীর ইজ্জত বাঁচাতে গিয়ে স্বামী, নাতনির ইজ্জত বাঁচাতে গিয়ে নানা বা দাদা, ছাত্রীর ইজ্জত রক্ষা করতে গিয়ে শিক্ষক খুন হয়েছেন। পুলিশ সদর দফতরের রেকর্ড বলছে, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত নারী নির্যাতনের অভিযোগ রেকর্ড হয়েছে ৩৮ হাজার ৫টি। একই সময়ে শিশু নির্যাতনের ঘটনা ২ হাজার ৫৩৮টি, যা আগের আড়াই বছরের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি।
সীমান্তে প্রতিবেশী বিএসএফের হাতে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশীদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিকদের পাখির মতো গুলি করে, কিংবা সাপ-কুকুরের মতো পিটিয়ে হত্যা করছে তারা। কুড়িগ্রাম সীমান্তে ফেলানীর ঝুলন্ত লাশ বিএসএফের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জ্বলন্ত উদাহরণ। এই সরকারের আমলে কমপক্ষে ২০৩ বাংলাদেশী নাগরিক বিএসএফের হাতে খুন হয়েছে। তাদের গুলি করে, পাথড় ছুড়ে, পানিতে ডুবিয়ে, বর্বর নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এসবের প্রতিবাদ না করে এই সরকার জনমতকে উপেক্ষা করে ভারতকে ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, করিডোরসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। চন্দননগর গ্রামসহ আমাদের হাজার হাজার একর জমি তুলে দেয়া হয়েছে ভারতের হাতে। অথচ ছিটমহলের মানুষের যে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে সেদিকে সরকার নজর দিচ্ছে না। ভারতের পূর্বাঞ্চলের স্বাধীনতাকামী সংগঠনের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাসহ অর্ধশতাধিক নেতাকে গোপনে ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
এ সরকারের আমলে রোষানলে পড়ে সংবাদপত্র ও সাংবাদিক। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে চ্যানেল ওয়ান ও শীর্ষ নিউজডটকম। ফেসবুক বন্ধ করে পরে খুলে দিতে বাধ্য হয়। আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে প্রেস সিলগালা করে হাজার খানেক সশস্ত্র পুলিশ। সারারাত অফিস অবরুদ্ধ করে রেখে সাংবাদিকদের মারধর করে তারা। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। রিমান্ডে ক্যান্টনমেন্ট থানাসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে তার ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন চালানো হয়েছে। মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদের মতো প্রবীণ সাংবাদিককে। প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করে হুমকি দেয়া হয়েছে জাতীয় দৈনিকের সম্পাদককে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, মামলা ও নির্যাতন চালানো হয়েছে। ১২ জন সাংবাদিক এ সরকারের আমলে নিহত হয়েছেন।
মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক অধিকার হরণের হাতিয়ার ১৪৪ ধারা। চলতি বছরে কমপক্ষে ৭৫টি স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। বিরোধী দলের প্রতিবাদ সভা প্রতিহত করতে সরকারি দল পরিকল্পিতভাবে সভা আহ্বান করে। আর প্রশাসন জারি করে ১৪৪ ধারা। অথচ সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, রাষ্ট্রের যে কোনো নাগরিকের শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা ও সরকারের সমালোচনা করার অধিকার রয়েছে।
এই সরকারের আমলে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু অর্থাত্ উপজাতিরাও নিরাপত্তা পাচ্ছেন না। তাদের বাড়িঘর, ফসলের মাঠ দখল, হামলা, খুন, হত্যা, রাহাজানি, শ্লীলতাহানি, প্রতিমা ভাংচুর, বাড়িতে ডাকাতি ও লুটপাটের ঘটনা অসংখ্য। সন্ত্রাস দমন আইন, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালাসহ বিভিন্ন আইন করে সরকার মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত করছে। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি খুনের আসামিদের দণ্ড মওকুফ করে দিয়েছেন। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় ৮ হাজার মামলা।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। ’৭২ সাল থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত রক্ষীবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর নৃশংসতা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছিল। নির্যাতনে ২৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে। এছাড়াও ওই সময় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় ১৯ হাজার মানুষ। গুম ও খুন হয় ১ লাখ। পিটিয়ে মারা হয় ৭ হাজার মানুষকে। জেলখানায় হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারা গিয়েছিল ৯ হাজার মানুষ। স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে প্রথম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নেতা প্রকৌশলী সিরাজ সিকদার। ’৭৫ সালের ২ জানুয়ারি পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হন তিনি। অনেকের মতে, ওই হত্যাকাণ্ড সরকারের প্রথম ক্রসফায়ার। ’৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে দৈনিক গড়ে ১ হাজার থেকে ১২০০ মানুষ মারা গেছে বলে ওই সময়কার রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।
’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের শাসন অবসান হলে ক্ষমতাসীন হন খন্দকার মোশতাক। তার শামনামলে ’৭৫ সালের ৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, স্বৈরাচার এরশাদ আমলেও দেশে মানবাধিকার বলে কিছু ছিল না। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি ওই সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটাতে থাকে সরকারের ছত্রছায়ায় গঠিত গুণ্ডাবাহিনী। আন্দোলন দমনের জন্য ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে ঘটানো হয়েছে বহু হত্যাকাণ্ড। কেড়ে নেয়া হয়েছিল মানুষের অধিকার। আন্দোলন দমনের জন্য ট্রাক তুলে দেয়া হয় মিছিলে। ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয় জনসভায় যোগ দেয়া মানুষকে। ওইসব হত্যাকাণ্ডের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। ওই সময় কালীগঞ্জের আজম খান বাহিনী, কেরানীগঞ্জের ইমদু ও ঢাকার গালকাটা কামাল বাহিনীর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে রাজনৈতিক দলের নেতা ও বিরোধী দলের কর্মীদের হত্যা করা হয়। ‘নতুন বাংলা ছাত্রসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করে ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে প্রকাশ্য ও গোপনে অসংখ্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। তাদের হাতে নিহতদের মধ্যে রাউফুন বসুনিয়া, নিমাই, সেলিম, জেহাদ, দেলোয়ার ও ডা. মিলনের নাম উল্লেখযোগ্য।
১৯৯৬ সালের জুন মাসে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এ সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘন ফের ভয়াবহ রূপ নেয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উত্থান হয় ভয়ঙ্কর গডফাদার বাহিনীর। ঢাকার হাজী মকবুল, নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান, ফেনীর জয়নাল হাজারী, লক্ষ্মীপুরের তাহের, গফরগাঁওয়ের আলতাফ গোলন্দাজ, চট্টগ্রামের তৈয়্যব বাহিনী, বরিশালের হাসনাত বাহিনী, চুয়াডাঙ্গার সেলুন বাহিনী, খুলনার সুজা ও কাজী আমিন বাহিনীসহ নানা সন্ত্রাসীচক্র ও গডফাদারের উত্থান ঘটে। তারা খুন ও রাহাজানির মাধ্যমে দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের কিছুদিন পরেই যশোরে কারাবিদ্রোহ দেখা দিলে অনেক বন্দি বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলের শেষ দিকে পুলিশের চিরুনি অভিযানে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিপুলসংখ্যক চরমপন্থী নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়।
২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। তখনও দেশে বন্ধ হয়নি মানবাধিকার লঙ্ঘন। ওই সময় ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামক অভিযান চলে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌবাহিনী, পুলিশ ও বিডিআরের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর অভিযানে তথাকথিত ‘হার্টঅ্যাটাক’-এ মৃত্যু হয়েছিল অন্তত ৪৪ জনের। প্রশ্নবিদ্ধ ওই অভিযান বন্ধ করে জাতীয় সংসদে বিল পাসের মাধ্যমে অভিযানে অংশ নেয়া সংস্থার সদস্যদের ইনডেমনিটি দেয়া হয়। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ মার্চ গঠন করা হয় র্যাব। তাদের হাতে প্রথম ক্রসফায়ার হয় ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নান। এরপর এযাবত্ র্যাবের হাতে আট শতাধিক এবং বিভিন্ন সময় পুলিশের ক্রসফায়ারে ১১শ’র বেশি লোক নিহত হয়েছে।
বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও সমাজচিন্তক ফরহাদ মজহার বলেন, যে মাত্রার বা যে চরিত্রেরই যে কোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন কোনো অবস্থাতে কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মানবাধিকার রক্ষার কাজ নিছকই কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার আহাজারির বিষয় নয়। এটা ব্যক্তির অধিকার।
সুপ্রিমকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, মানবাধিকার শুধু কতগুলো লিপিবদ্ধ অধিকার নয়, মানবাধিকার হচ্ছে সব ক্ষেত্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠা। কারও সঙ্গে কটু কথা না বলে সদাচরণ করা, হাসিমুখে কথা বলা—এগুলোও মানবাধিকার।
প্রবীণ সাংবাদিক আতাউস সামাদ বলেন, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু ঘটছে, চলেছে গুম হওয়ার মিছিল। একজন আইনজীবী হাইকোর্ট-ঘটনায় গ্রেফতার হয়ে পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারা গেলেও আদালত এ বিষয়ে কোনো তদন্ত করেননি। বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পুলিশ প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করলেও জাতীয় সংসদ কর্তৃপক্ষ এতে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। এখন শোনা যাচ্ছে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা এদেশের নাগরিক বা এদেশে বসবাসরত লোকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে এ দেশের আদালতের কোনো নির্দেশ বা অনুমতি ছাড়া। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও থেমে নেই। আবার নেই দুর্বৃত্তদের হাত থেকে সুরক্ষা পাওয়ার নিশ্চয়তা। আর দুর্নীতিপরায়ণরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতি অবাধে ঘটিয়ে জনজীবনে নাভিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার অপসৃয়মাণ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, দেশের সাধারণ মানুষের জীবন উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কাটছে। বর্তমানে এমন একটি সময় চলছে, মানুষ রাতে ঘুমাতে গেলে সকালে কী হবে তা জানে না। ঘর থেকে বের হলে নিরাপদে আবার ফিরতে পারবে কিনা তাও অনিশ্চিত। মানুষের জীবনের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। মানবাধিকার বিষয়ে আমাদের অর্জন অনেক হলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী এখনও আমরা অনেক দূরে রয়েছি।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনবিদ ও সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীন দলই মানবাধিকার লঙ্ঘনের মূল হোতা হিসেবে কাজ করে। রাষ্ট্রের মদত ছাড়া কারও পক্ষেই আইন ভঙ্গ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ নেই। যে কোনো বিবেচনায় দেশের সর্বজনীন মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। নতুন করে এখন গুপ্তহত্যা ও গুম-আতঙ্ক তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে দেশবাসীকে। দেশ বা রাষ্ট্র কিছু লোককে বেআইনিভাবে মানুষ হত্যার জন্য সরকারিভাবে লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুন করে ডাহা মিথ্যা কথা বলছে—এটা সব মানুষের কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট। একইভাবে অপহরণের পর যাদের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না—এগুলো নিশ্চয়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করছে।
বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দেশের সাধারণ মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, সে অনুযায়ী মানবাধিকার পরিস্থিতির কখনও উন্নতি হয়নি; বরং দিন দিন তা খারাপের দিকে যাচ্ছে। তাই বলতে হয়, বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি মোটেই ভালো নয়। আমরা দেখছি মানুষের যে প্রত্যাশা, বাস্তব অবস্থা তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
লঙ্ঘনের হেন অপরাধ নেই, যা এখন ঘটছে না।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে সংবেদনশীল মামলায় বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতাদের জড়াচ্ছে যথেচ্ছভাবে। রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে হাজির করা হচ্ছে আদালতে। ঠুনকো অজুহাতে গ্রেফতার করে বানোয়াট মামলায় রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন মামলা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। নাগরিক দুর্ভোগ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমনই যে, ঘরে বসেও নিরাপদ বোধ করছে না মানুষ।
মানবাধিকার কর্মী ও বিশিষ্টজনদের মতে, ‘মানবাধিকার’ এমন একটি সর্বজনীন বিষয়, যা কোনো দেশের ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ করা যায় না। মানবাধিকার জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সব দেশে, সব সমাজে, সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। এটি জাত মানে না, ধর্ম চেনে না, দেশ-কাল-পাত্রও চেনে না। এটা বিশ্বের সবার সর্বজনীন একটি সম্পদ।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের জন্মের পর থেকে প্রায় সব সরকারের সময়েই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই দেশজুড়ে শুরু হয় দখল, চাঁদাবাজি আর রাজনৈতিক সহিংসতা। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম ১৫ দিনেই রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছিল ১৫ জন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তাণ্ডব চালায় ছাত্রলীগ। শুরু হয় হাটবাজার, মাঠঘাট, বিল-বাঁওড় দখলের প্রতিযোগিতা। দখলবাজদের গ্রাসে পড়ে নিরীহ মানুষের জমি, বালিমহাল, কবরস্থান এবং পাবলিক টয়লেটও। পাল্লা দিয়ে চলে টেন্ডারবাজি। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর টেন্ডার নিয়ে রক্তাক্ত লড়াই চলে সরকার সমর্থকদের মধ্যে। এসব লড়াই ছিল ছাত্রলীগের নানা গ্রুপ; ছাত্রলীগ বনাম যুবলীগ অথবা যুবলীগ বনাম স্বেচ্ছাসেবক লীগের মধ্যে।
এই সরকারের অভিষেকের দু’মাসের মাথায় ৫৭ দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারসহ ৭৪ জনকে হত্যার মধ্য দিয়ে ঘটে ‘পিলখানা ট্র্যাজেডি’। বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) জওয়ানদের রিমান্ডে নিয়ে চলে নির্যাতন, প্রকৃত অপরাধীদের অনেকেই থেকে গেছে আড়ালে। জিজ্ঞাসাবাদকালে ২০০৯ সালেই নিহত হয় ৫১ জওয়ান। মহাজোটের শাসনের মাত্র দু’মাসের মাথায় এমন বিভীষিকা দেখে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল মন্তব্য করেছিল, ‘আগামী পাঁচ বছর দেশে শনির দশা বিরাজ করবে। কারণ শুরুটাই বলে দেয়, দিনটি কেমন যাবে।’ বাস্তবে ঘটছেও তাই।
২০০৯ সালে ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউয়ের (ইউপিআর) শুনানিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানোর কথা বলেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের জন্য প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের ডজনখানেক মন্ত্রী, পুলিশের আইজি, র্যাবের ডিজিসহ অনেকেই ঘোষণা দেন। বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, গুলিবিনিময়সহ বিভিন্ন নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা চলছেই। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের রেকর্ডে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ৩৪৭টি। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে মারা গেছে ১৭২ জন। চলতি বছরের ৯ মাসে হেফাজতে নিহত হয়েছে ১১৫ জন। এই সময় গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার শতাধিক ব্যক্তি। চলতি বছরই ১৭ ব্যক্তিকে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা তুলে নেয়ার পর এখন পর্যন্ত তারা নিখোঁজ।
২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত ৫৬৬ জন। আহত হয়েছেন ৪০ হাজার। পুলিশ সদর দফতরের রেকর্ড বলছে, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশে খুন হয়েছে ১০ হাজার ৭০টি, অর্থাত্ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১২টি। এর বাইরে রয়েছে ক্রসফায়ার, গুপ্তহত্যা, অপহরণ ও গুম। একই সময়ে দেশে ফৌজদারি অপরাধে মামলা হয়েছে ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৯৬১টি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশ ও সরকারি দল এসব মামলা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও বিরোধী দলকে দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
রাজনৈতিক সহিংসতা, মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের আরেকটি উদাহরণ বিরোধীদের দমন। আন্দোলনে রাস্তায় নামলেই পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার, মোবাইল কোর্ট বসিয়ে তাত্ক্ষণিক শাস্তি, বেধড়ক লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল, ধরে নিয়ে নির্যাতন এবং ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের লেলিয়ে দিয়ে হামলা চালানো হচ্ছে। হরতালে মিছিল করায় গত ৭ জুলাই বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর বর্বর হামলা করে পুলিশ। গত ১২ জুনসহ বিভিন্ন সময়ের হরতালে মহিলা নেত্রী নূরে আলম সাফাসহ বয়োজ্যেষ্ঠ কর্মীদের ওপরও হামলা চালানো হয়। ২০১০ সালের ২৭ জুন বিরোধী দলের ডাকা প্রথম হরতালের দিনই মির্জা আব্বাসের বাড়িতে হামলা চালায় র্যাব। ওলামা-মাশায়েখদের হরতালে কাঁচপুর সানারপাড়সহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও সরকারি দলের ক্যাডারদের নৃশংস হামলা ও তাণ্ডব চলেছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর চারদলীয় জোটের ডাকা হরতালের দিন পিকেটার ও ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের কর্মচারী ইউসুফ আলীর বুকে পুলিশ বুটজুতা দিয়ে নির্যাতন চালায়। এই দৃশ্য দেশ-বিদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের আরেকটি উদাহরণ গণপিটুনিতে মৃত্যু। অধিকারের রিপোর্ট থেকে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে দেশে ১২০ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে। গত ২৭ জুলাই নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে ৬ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে কিশোর শামসুদ্দীন মিলনকে পুলিশ গাড়ি থেকে নামিয়ে সহিংস জনতার মধ্যে ছেড়ে দেয়। তাদের উপস্থিতিতেই জনতা কিশোরটিকে পিটিয়ে হত্যা করে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর মিলনের লাশ পুলিশই আবার তাদের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। গত ১৭ জুলাই রাতে রাজধানীর আমিনবাজারে ডাকাত বানিয়ে গণপিটুনিতে ৬ ছাত্রকে মেরে ফেলা হয়। পুলিশের তদন্তেই তাদের দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ মেলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই ভূমিকা আইনের প্রতি মানুষের আস্থাকে দুর্বল করবে। দেশকে ঠেলে দেবে মারাত্মক নৈরাজ্যের দিকে।
এই সরকারের আড়াই বছরে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে নারীর প্রতি। শুধু বোরকা পরার কারণে পিরোজপুর, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে নিরীহ নারীদের হয়রানি করা হয়েছে। ইভটিজিং এখন এক ভয়াবহ ব্যাধি। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, তথা ক্ষমতাসীনদের আশ্রিতরা যৌন লালসা মেটানের জন্য নারীর প্রতি হামলে পড়ছে। তাদের হাতে ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে অসংখ্য নারী। অনেকে নিজের ইজ্জত বাঁচাতে আত্মহত্যা করেছে। মেয়ের ইজ্জত বাঁচাতে গিয়ে বাবা, স্ত্রীর ইজ্জত বাঁচাতে গিয়ে স্বামী, নাতনির ইজ্জত বাঁচাতে গিয়ে নানা বা দাদা, ছাত্রীর ইজ্জত রক্ষা করতে গিয়ে শিক্ষক খুন হয়েছেন। পুলিশ সদর দফতরের রেকর্ড বলছে, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত নারী নির্যাতনের অভিযোগ রেকর্ড হয়েছে ৩৮ হাজার ৫টি। একই সময়ে শিশু নির্যাতনের ঘটনা ২ হাজার ৫৩৮টি, যা আগের আড়াই বছরের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি।
সীমান্তে প্রতিবেশী বিএসএফের হাতে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশীদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। নিরীহ বাংলাদেশী নাগরিকদের পাখির মতো গুলি করে, কিংবা সাপ-কুকুরের মতো পিটিয়ে হত্যা করছে তারা। কুড়িগ্রাম সীমান্তে ফেলানীর ঝুলন্ত লাশ বিএসএফের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জ্বলন্ত উদাহরণ। এই সরকারের আমলে কমপক্ষে ২০৩ বাংলাদেশী নাগরিক বিএসএফের হাতে খুন হয়েছে। তাদের গুলি করে, পাথড় ছুড়ে, পানিতে ডুবিয়ে, বর্বর নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এসবের প্রতিবাদ না করে এই সরকার জনমতকে উপেক্ষা করে ভারতকে ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট, করিডোরসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। চন্দননগর গ্রামসহ আমাদের হাজার হাজার একর জমি তুলে দেয়া হয়েছে ভারতের হাতে। অথচ ছিটমহলের মানুষের যে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে সেদিকে সরকার নজর দিচ্ছে না। ভারতের পূর্বাঞ্চলের স্বাধীনতাকামী সংগঠনের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাসহ অর্ধশতাধিক নেতাকে গোপনে ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
এ সরকারের আমলে রোষানলে পড়ে সংবাদপত্র ও সাংবাদিক। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে চ্যানেল ওয়ান ও শীর্ষ নিউজডটকম। ফেসবুক বন্ধ করে পরে খুলে দিতে বাধ্য হয়। আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে প্রেস সিলগালা করে হাজার খানেক সশস্ত্র পুলিশ। সারারাত অফিস অবরুদ্ধ করে রেখে সাংবাদিকদের মারধর করে তারা। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। রিমান্ডে ক্যান্টনমেন্ট থানাসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে তার ওপর বর্বরোচিত নির্যাতন চালানো হয়েছে। মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদের মতো প্রবীণ সাংবাদিককে। প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করে হুমকি দেয়া হয়েছে জাতীয় দৈনিকের সম্পাদককে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, মামলা ও নির্যাতন চালানো হয়েছে। ১২ জন সাংবাদিক এ সরকারের আমলে নিহত হয়েছেন।
মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাজনৈতিক অধিকার হরণের হাতিয়ার ১৪৪ ধারা। চলতি বছরে কমপক্ষে ৭৫টি স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। বিরোধী দলের প্রতিবাদ সভা প্রতিহত করতে সরকারি দল পরিকল্পিতভাবে সভা আহ্বান করে। আর প্রশাসন জারি করে ১৪৪ ধারা। অথচ সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে, রাষ্ট্রের যে কোনো নাগরিকের শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা ও সরকারের সমালোচনা করার অধিকার রয়েছে।
এই সরকারের আমলে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু অর্থাত্ উপজাতিরাও নিরাপত্তা পাচ্ছেন না। তাদের বাড়িঘর, ফসলের মাঠ দখল, হামলা, খুন, হত্যা, রাহাজানি, শ্লীলতাহানি, প্রতিমা ভাংচুর, বাড়িতে ডাকাতি ও লুটপাটের ঘটনা অসংখ্য। সন্ত্রাস দমন আইন, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালাসহ বিভিন্ন আইন করে সরকার মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত করছে। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি খুনের আসামিদের দণ্ড মওকুফ করে দিয়েছেন। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় ৮ হাজার মামলা।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। ’৭২ সাল থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত রক্ষীবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর নৃশংসতা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছিল। নির্যাতনে ২৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে। এছাড়াও ওই সময় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় ১৯ হাজার মানুষ। গুম ও খুন হয় ১ লাখ। পিটিয়ে মারা হয় ৭ হাজার মানুষকে। জেলখানায় হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারা গিয়েছিল ৯ হাজার মানুষ। স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে প্রথম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নেতা প্রকৌশলী সিরাজ সিকদার। ’৭৫ সালের ২ জানুয়ারি পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হন তিনি। অনেকের মতে, ওই হত্যাকাণ্ড সরকারের প্রথম ক্রসফায়ার। ’৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে দৈনিক গড়ে ১ হাজার থেকে ১২০০ মানুষ মারা গেছে বলে ওই সময়কার রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।
’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের শাসন অবসান হলে ক্ষমতাসীন হন খন্দকার মোশতাক। তার শামনামলে ’৭৫ সালের ৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, স্বৈরাচার এরশাদ আমলেও দেশে মানবাধিকার বলে কিছু ছিল না। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি ওই সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটাতে থাকে সরকারের ছত্রছায়ায় গঠিত গুণ্ডাবাহিনী। আন্দোলন দমনের জন্য ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে ঘটানো হয়েছে বহু হত্যাকাণ্ড। কেড়ে নেয়া হয়েছিল মানুষের অধিকার। আন্দোলন দমনের জন্য ট্রাক তুলে দেয়া হয় মিছিলে। ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয় জনসভায় যোগ দেয়া মানুষকে। ওইসব হত্যাকাণ্ডের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। ওই সময় কালীগঞ্জের আজম খান বাহিনী, কেরানীগঞ্জের ইমদু ও ঢাকার গালকাটা কামাল বাহিনীর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে রাজনৈতিক দলের নেতা ও বিরোধী দলের কর্মীদের হত্যা করা হয়। ‘নতুন বাংলা ছাত্রসমাজ’ প্রতিষ্ঠা করে ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে প্রকাশ্য ও গোপনে অসংখ্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। তাদের হাতে নিহতদের মধ্যে রাউফুন বসুনিয়া, নিমাই, সেলিম, জেহাদ, দেলোয়ার ও ডা. মিলনের নাম উল্লেখযোগ্য।
১৯৯৬ সালের জুন মাসে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এ সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘন ফের ভয়াবহ রূপ নেয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উত্থান হয় ভয়ঙ্কর গডফাদার বাহিনীর। ঢাকার হাজী মকবুল, নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান, ফেনীর জয়নাল হাজারী, লক্ষ্মীপুরের তাহের, গফরগাঁওয়ের আলতাফ গোলন্দাজ, চট্টগ্রামের তৈয়্যব বাহিনী, বরিশালের হাসনাত বাহিনী, চুয়াডাঙ্গার সেলুন বাহিনী, খুলনার সুজা ও কাজী আমিন বাহিনীসহ নানা সন্ত্রাসীচক্র ও গডফাদারের উত্থান ঘটে। তারা খুন ও রাহাজানির মাধ্যমে দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের কিছুদিন পরেই যশোরে কারাবিদ্রোহ দেখা দিলে অনেক বন্দি বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলের শেষ দিকে পুলিশের চিরুনি অভিযানে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিপুলসংখ্যক চরমপন্থী নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়।
২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। তখনও দেশে বন্ধ হয়নি মানবাধিকার লঙ্ঘন। ওই সময় ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ নামক অভিযান চলে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌবাহিনী, পুলিশ ও বিডিআরের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর অভিযানে তথাকথিত ‘হার্টঅ্যাটাক’-এ মৃত্যু হয়েছিল অন্তত ৪৪ জনের। প্রশ্নবিদ্ধ ওই অভিযান বন্ধ করে জাতীয় সংসদে বিল পাসের মাধ্যমে অভিযানে অংশ নেয়া সংস্থার সদস্যদের ইনডেমনিটি দেয়া হয়। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২১ মার্চ গঠন করা হয় র্যাব। তাদের হাতে প্রথম ক্রসফায়ার হয় ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নান। এরপর এযাবত্ র্যাবের হাতে আট শতাধিক এবং বিভিন্ন সময় পুলিশের ক্রসফায়ারে ১১শ’র বেশি লোক নিহত হয়েছে।
বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও সমাজচিন্তক ফরহাদ মজহার বলেন, যে মাত্রার বা যে চরিত্রেরই যে কোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন কোনো অবস্থাতে কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মানবাধিকার রক্ষার কাজ নিছকই কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার আহাজারির বিষয় নয়। এটা ব্যক্তির অধিকার।
সুপ্রিমকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, মানবাধিকার শুধু কতগুলো লিপিবদ্ধ অধিকার নয়, মানবাধিকার হচ্ছে সব ক্ষেত্রে ন্যায় প্রতিষ্ঠা। কারও সঙ্গে কটু কথা না বলে সদাচরণ করা, হাসিমুখে কথা বলা—এগুলোও মানবাধিকার।
প্রবীণ সাংবাদিক আতাউস সামাদ বলেন, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু ঘটছে, চলেছে গুম হওয়ার মিছিল। একজন আইনজীবী হাইকোর্ট-ঘটনায় গ্রেফতার হয়ে পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারা গেলেও আদালত এ বিষয়ে কোনো তদন্ত করেননি। বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুককে পুলিশ প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করলেও জাতীয় সংসদ কর্তৃপক্ষ এতে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। এখন শোনা যাচ্ছে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা এদেশের নাগরিক বা এদেশে বসবাসরত লোকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে এ দেশের আদালতের কোনো নির্দেশ বা অনুমতি ছাড়া। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও থেমে নেই। আবার নেই দুর্বৃত্তদের হাত থেকে সুরক্ষা পাওয়ার নিশ্চয়তা। আর দুর্নীতিপরায়ণরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতি অবাধে ঘটিয়ে জনজীবনে নাভিশ্বাস সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার অপসৃয়মাণ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, দেশের সাধারণ মানুষের জীবন উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কাটছে। বর্তমানে এমন একটি সময় চলছে, মানুষ রাতে ঘুমাতে গেলে সকালে কী হবে তা জানে না। ঘর থেকে বের হলে নিরাপদে আবার ফিরতে পারবে কিনা তাও অনিশ্চিত। মানুষের জীবনের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। মানবাধিকার বিষয়ে আমাদের অর্জন অনেক হলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী এখনও আমরা অনেক দূরে রয়েছি।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনবিদ ও সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীন দলই মানবাধিকার লঙ্ঘনের মূল হোতা হিসেবে কাজ করে। রাষ্ট্রের মদত ছাড়া কারও পক্ষেই আইন ভঙ্গ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ নেই। যে কোনো বিবেচনায় দেশের সর্বজনীন মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। নতুন করে এখন গুপ্তহত্যা ও গুম-আতঙ্ক তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে দেশবাসীকে। দেশ বা রাষ্ট্র কিছু লোককে বেআইনিভাবে মানুষ হত্যার জন্য সরকারিভাবে লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুন করে ডাহা মিথ্যা কথা বলছে—এটা সব মানুষের কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট। একইভাবে অপহরণের পর যাদের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না—এগুলো নিশ্চয়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করছে।
বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দেশের সাধারণ মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, সে অনুযায়ী মানবাধিকার পরিস্থিতির কখনও উন্নতি হয়নি; বরং দিন দিন তা খারাপের দিকে যাচ্ছে। তাই বলতে হয়, বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি মোটেই ভালো নয়। আমরা দেখছি মানুষের যে প্রত্যাশা, বাস্তব অবস্থা তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
No comments:
Post a Comment